কৃষিজমি যাচ্ছে বসতির দখলে!

:: দেবদাস মজুমদার,বিশেষ প্রতিনিধি,উপকূল অঞ্চল

ফসলের জমি নষ্ট করে অবকাঠামো নির্মাণ

ফসলের জমি নষ্ট করে অবকাঠামো নির্মাণ

ষাটোর্ধ কৃষক আব্দুল হাকিম হাওলাদারের চার ছেলে। তাঁর আবাদী জমির পরিমাণ ছয় একর। এই কৃষিজমির ওপরই নির্ভশীল আব্দুল হাকিমের পরিবার। চার ছেলেকে নিয়ে গত দশ বছর আগেও ছিল তাঁর একান্নবর্তী সংসার। সময়ের প্রয়োজনেই এ একান্নবর্তী পরিবারটি ভেঙে এখন চার ভাগ হয়েছে। তিন ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। তিন ছেলের নতুন বসতির জন্য কৃষিজমি ভাগ করতে হয় তাকে। আর আবাদী জমিতে নতুন ভিটি গড়ে সেখানেই তৈরী হয়েছে তিন ছেলের ঘর। সংগত কারণেই কৃষক আব্দুল হাকিমের কৃষি জমি কমে গেছে।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার টিকিকাটা ইউনিয়নের সূর্যমণি গ্রামের কৃষক আব্দুল হাকিম হাওলাদারই শুধু উপায়হীন হয়ে কৃষিজমি নষ্ট করে বসতি গড়ে তোলেননি। উপজেলার ১১ ইউনিয়নের সর্বত্রই কৃষিজমি মাঠজুড়েই গড়ে উঠছে নতুন নতুন বসতি। আর আশংকাজনক হারেই এখানে কৃষিজমি কমছে।

সরেজমিনে উপকূলীয়  পিরোজপুরের  কয়েকটি  গ্রাম ঘুরে কৃষিজমির ওপর বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলে আবাদী জমির যথেচ্ছ ব্যবহারের চিত্র দেখা গেছে। কোথাও কৃষিজমি জুড়ে গড়ে উঠছে নতুন ঘর, কোথাও ইটভাটা তৈরি করে কৃষিজমি স্থায়িভাবে অনাবাদীতে পরিণত করা হচ্ছে, কোথাও আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে কৃষিজমি বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে এবং কৃষিজমির ওপর এসব ঘটছে একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে।

কৃষিজমি কমছে…

প্রতিবছর বাড়ছে মানুষ, কমছে কৃষিজমি। সেই সঙ্গে আবাদী জমিও বছর বছর হচ্ছে অনাবাদী। নানা প্রক্রিয়ায় কমছে কৃষিজমি। মানুষের নিত্য নতুন আবাসন, রাস্তাঘাট আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে কৃষি জমিতেই। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় ইটের ভাটা গড়ে কৃষিজমিকে একধরনের স্থায়ী অনাবাদী করা হচ্ছে।

কৃষি  অধিদপ্তর সূত্রে জানাগেছে, প্রতিবছর এসব কারণে সরকারি হিসেব মতে এক শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। এতে বছরে গড়ে ২৩০ হেক্টর করে কৃষি জমি নিঃশেষ হচ্ছে।

সোনাখালী  গ্রামের সমাজকর্মী মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, “কৃষিজমি প্রতিবছর কি পরিমাণ স্থাপনার দখলে যাচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় প্রকৃত অবস্থা বোঝা মুস্কিল। সঠিক পরিসংখ্যান করে কৃষিজমি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

একান্নবর্তী পরিবার ভাঙছে…

উপকূলীয় মঠবাড়িয়ার টিকিকাটা ইউনিয়নের ভেচকী গ্রামের দিনমজুর আব্দুল আজিজের দুই ছেলে। বড় ছেলে আব্দুল মান্নান হাওলাদার ও ছোট ছেলে মন্টু হাওলাদার। এই পরিবারটির মাত্র একবিঘা কৃষিজমি। গত চার মাস আগেও পরিবারটি একান্নবর্তী ছিল। বড়ছেলে আব্দুল মান্নান বিয়ে করার পর তুচ্ছ বিষয় নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দে তাকে আলাদা হতে হয়। এ কারণে মান্নানকে ৬ কাঠা কৃষিজমি ভাগ করে দেন তার বাবা। ওই কৃষিজমিতেই তিনি গড়ে তোলেন নতুন বসতি। পুকুর আর ঘরের স্থাপনা মিলিয়ে মান্নানের সব জমিই শেষ। তার আর কোন কৃষিজমিই রইলনা। শুধু মান্নানই নন সম্পদ নিয়ে মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতার লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত ভাঙছে পরিবার। জনসংখ্যার চাপ আর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বৈরীতার প্রভাব পড়ছে গিয়ে কৃষিজমির ওপর। আলাদা অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে কৃষিজমির ওপর।

ভেচকী গ্রামের ষাটোর্ধ কৃষক আব্দুল লতিফ মনে করেন এটাই স্বাভাবিক। পরিবারে ছেলের সংখ্যা বেশি হলে পরিবার ভাঙবেই। স্বার্থের কারণেই মানুষের এক সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। এটাই বাস্তবতা বলে মনে করেন এই কৃষক। তিনি বলেন, “আগের চাইতে মানুষ কৃষি কাজে এখন যেন কম আগ্রহ দেখা দিয়েছে। অথচ কৃষি ছাড়া  গ্রামের মানুষ কখনও বাঁচবে না”।

মঠবাড়িয়া মহিউদ্দিন আহম্মেদ মহিলা মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মো. ইকতিয়ার হোসেন পান্না বলেন, “মানুষের অসহিষ্ণুতা আর আত্মকেন্দ্রিকতাই একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনের মূলে নয়। এর সঙ্গে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ আর মানুষের কৃষির প্রতি অগ্রসরতার মানসিক দ্বন্দেরও একটা প্রভাব আছে। কৃষিজমি নিবিড় ব্যবহার এমনিতেই কমছে। এমন অবস্থায় সবকিছু নিয়ে এখনই না ভাবলে কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা সম্ভব হবে না।

সোনাখালী গ্রামের ব্যবসায়ী মো. আবু মুন্সি বলেন, “কৃষিজমিতে এভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে স্থাপনা উঠলে তা উৎপাদনে প্রভাব পড়বেই। কৃষিজমি সুরক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

ইটভাটা: আরেক আগ্রাসন…

মঠবাড়িয়া উপলোর ১১ ইউনিয়নে দুই শতাধিক  ইটের ভাটা গড় উঠেছে। প্রভাশালী লোকেরাই এসব ইটভাটার মালিক। সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ইটভাটাই কৃষিজমিতে স্থাপন করা হয়েছে। তুষখালী ইউনিয়নের বলেশ্বর  নদ তীরবর্তী চরে প্রায় ২০ একর জমি দখল করে স্থানীয় এক প্রভাবশালী সেখানে বিশাল ইটের ভাটা গড়ে তুলেছেন। সাপলেজা ইউনিয়নের ভাইজোড়া গ্রামের প্রায় ১৫ একর জমি দখল করে সেখান্ ইটভাটা গড়ে তুলেছেন। চরের কৃষিজমিতে ইটপোড়ানোর জন্য কৃষিজমির মাটি কেটে ফেলা হচ্ছে।

উপজেলা প্রশাসন দাবি করেছে বিশাল এলাকাজুড়ে এমন ইট ভাটা এ উপজেলায় আছে মাত্র চারটি। তারা প্রশাসনের অনুমোদন নিয়েই ভাটা স্থাপন করেছেন। এগুলো নদীতীরর্তী চর এলাকায়। বাকীগুলো ইট ভাটা নয় সেগুলো ছোট ছোট ইটের পাজা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ইটভাটা কিংবা ইটের পাজা স্থাপনকৃত কৃষিজমি এখন স্থায়ীভাবেই অনাবাদী হয়ে পড়েছে। যেখানে এসব ভাটা গড়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে তার আশপাশজুড়ে মাটির উর্বরতাও কমে গেছে।

দক্ষিণ মিঠাখালী গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, “কৃষিজমিতে ইটভাটা গড়লে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ফসল উৎপাদন সম্ভব হয় না।  এছাড়া ইটভাটা স্থাপনের আশপাশের জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।”

মঠবাড়িযা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব  জানান, গত বছর এ উপজেলায় কৃষিজমিতে অনুমোদনবিহীন কিছু ইট পোড়ানোর পাজা স্থাপন করা হয়েছিল। এসব ইটপাজা মালিকের  বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ায় এবার কৃষি জমিতে ইটেরপাজা স্থাপনের মাত্রা কমে গেছে।

যে কারণে কৃষিজমির বিপর্যয়…

কৃষি অধিদপ্তরের মতে, কৃষিজমি বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে প্রধানত কয়েকটি কারণে আর তা হলো, কৃষকের দুরদর্শী জ্ঞানের অভাব, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, ভূমিখেকো ও অসাধু ইটভাটা মালিকদের আগ্রাসন। আর এসব বন্ধে কার্যকর কোন আইন না থাকা। কিংবা যেটুকু আইন আছে তারও কোন প্রয়োগ না থাকা।

স্থানীয় কৃষি ও পরিবেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) এর কর্মসূচি কর্মকর্তা সত্য রঞ্জন সাহা বলেন, “কৃষিজমি সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট আইন না থাকা কিংবা যেটুকু আছে তারও কোন প্রয়োগ না থাকার ফলে আমাদের কৃষিজমির যথেচ্ছাচার ব্যবহার করে নষ্ট করা হচ্ছে। কৃষিজমি নিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আগেই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

ফসলের মাঠ এভাবেই চলে যাচ্ছে বসত ভিটার দখলে

ফসলের মাঠ এভাবেই চলে যাচ্ছে বসত ভিটার দখলে

সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই…

প্রতিবছর  মানুষের বসতি ও অবকাঠামোগত কারণে কি পরিমাণ কৃষিজমি কমছে কিংবা কি পরিমাণ জমি অনাবাদী হয়ে পড়ছে তার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে।

উপজেলা পরিসংখ্যান অফিস ও কৃষি অফিসের দেয়া তথ্যের সাথেও মাঠপর্যায়ের বাস্তব পরিস্থিতির কোন মিল নেই। অনুসন্ধানে দেখা গেছে কৃষিজমি সংক্রান্ত ওই দুই দপ্তরে সংরক্ষিত তথ্যে গড়মিল রয়েছে। এমনকি সরকারি কোনদপ্তর ও বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানে কৃষিজমির এই বিপর্যয়ের কোন তথ্য নেই।

উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী মঠবাড়িয়ায় একফসলি আবাদযোগ্য কৃষিজমির পরিমাণ ৬০ হাজার ৭শ’ ১১ একর আর আবাদযোগ্য অনাবাদী জমির পরিমাণ এক হাজার ৪৩১ একর। কৃষিজমির এই পরিসংখ্যান থাকলেও কৃষিজমিতে বসতিসহ অবকাঠামো গড়ে তোলায় কি পরিমাণ জমি কমছে তার কোন সঠিক তথ্য এ দপ্তরে নেই।

উপজেলা কৃষি অফিসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, উপজেলার এক ফসলি, দো ফসলি ও তিন ফসলি মিলিয়ে  মোট আবাদী কৃষিজমির পরিমাণ ২৩ হাজার হেক্টর। কিন্তু প্রতিবছর কৃষিজমি কমে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্যও এ দপ্তরে নেই। এই তথ্য রাখার প্রয়োজনীয়তা খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি তাদের মধ্যে।

তবে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হরষিত চন্দ্র কীর্তুনীয়া বলেন, “প্রতিদিনই আমাদের কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জনসংখ্যার উর্ধ্বগতির কারণে কৃষিজমিতে বসতি বাড়ছে।” তবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কৃষিজমি ব্যবহার করা যথাযথ নয়। এক্ষেত্রে কৃষিজমির সনদ গ্রহণ ছাড়া তা হস্থান্তর কিংবা কৃষি ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করলে অনুমোদন নিতে হবে। কৃষিজমি ব্যবহার করে ইট পোড়ানোর কাজ বন্ধ করতে হবে। তবে কৃষিজমির ডাটাবেজ তথ্য সংরক্ষণ ছাড়া এটা কার্যকরভাবে সম্ভব হবে না।

কৃষিজমি সুরক্ষায় আইন…

কৃষিজমির যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে কৃষিজমিতে স্থাপনা নির্মাণ নিষ্দ্ধি করে সরকার সম্প্রতি একটি খসড়া আইন তৈরি করেছেন। কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন ২০১১-এর খসড়া ওই আইনে বলা হয়েছে, কৃষিজমি নষ্ট করে বাড়িঘর, শিল্পকারখানা, ইটখোলা এবং অন্যান্য অকৃষি স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। এ আইন অমান্য করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদন্ড অথবা ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের সুপারিশ করা করা হয়েছে। তবে যাঁদের তিন থেকে পাঁচ শতক কৃষিজমি আছে তাঁরা অপরিহার্য ক্ষেত্রে বসতবাড়ি নির্মাণ করতে চাইলে আইনের বিধান অনুযায়ী ভূমি জোনিং মানচিত্র অনুযায়ী তা করতে পারবেন।

happy wheels 2

Comments