একজন সাদা মনের মানুষ শিক্ষক আলী ওসমান
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
নেত্রকোনা জেলায় কাইলাটি ইউনিয়নের বালি অনন্তপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারের সন্তান আলী ওসমান। পেশায় তিনি বালি আব্বাছিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক। ১৯৭২ সালে আব্বাছিয়া বালি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসি, ১৯৭৪ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৭৬ সালে বিএসসি ও ১৯৮৪ সালে এমএসসি পাস করে আব্বাছিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন।
বিদ্যালয়ে যোগদানের পর শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। আলী ওসমানসহ মোট চারজন শিক্ষক ঐ স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ঐ শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তিনি কখনও চেয়ারে বসতেন না। তিনি টুলে বসে তার কর্মজীবনের প্রায় ১২ বছর কাটিয়েছেন। দীর্ঘদিন টুলে বসে কাজ করায় ঐ স্কুলের সকল শিক্ষকরা অনেক অনুরোধ করে তাকে চেয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে বসান। তিনি সর্বদা এলাকার মানুষের বিভিন্ন বিপদে আপদে পাশে থাকেন। এলাকার দুঃস্থ, ভূমিহীন ও শ্রমজীবি মানুষদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বালুয়াকান্দা ভ’মিহীন সমবায় সমিতি’। ১৯৮৫ সালে সমিতির সদস্যরা শিক্ষক আলি ওসমানকে সেই সমিতির সভাপতি নির্বাচন করেন।
তিনি নিজ উদ্যোগে যুবকদের বই পড়ার সুবিধার্থে একটি পাঠাগার গড়ে তুলেন। এলাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি নিজে। গ্রামে মানুষের সুখ দুঃখের নিত্যসঙ্গী তিনি। আব্বাছিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক অবসর গ্রহণের পর এলাকাবাসী ও স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্যগণ শিক্ষক আলী ওসমানকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দাযিত্ব অর্পন করেন। তারই নেতৃত্বে স্কুলটি বর্তমানে নেত্রকোনা অন্যতম সেরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্থান পেয়েছে। স্কুলে বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় এক হাজার দুইশত জন। স্কুলের শিক্ষক সংখ্যা মোট ১৭ জন। স্কুলে বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য এই তিনটি বিভাগ রয়েছে।
আগামীতে স্কুলে কম্পিউটার শিক্ষা শাখা চালু করার পরিকল্পনা করছেন তিনি। শিক্ষকতা শুরুর পর থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে কোচিং এ শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। যেসকল দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ (বই, খাতা, কলম, স্কুল ড্রেস) কেনার সমার্থ নেই, তিনি তাদের জন্য নিজের টাকায় উপকরণ কিনে দেন। স্কুলের সময়ের পর অবসর সময়টুকু তিনি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় সহযোগিতা করেন। এজন্য তিনি তাদের কাছ থেকে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন না। শিক্ষার্থীরা সামর্থ অনুযায়ী পারিশ্রমিক দিতে চাইলে তিনি বলেন,‘এ টাকা দিয়ে তোমরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ কিনো। আর লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হয়ে যখন ভালো চাকরী করবে তখন আমাকে উপহার কিনে দিও।’
শিক্ষার্থীদের তিনি কমপিউটার, ফ্যান, কাপড়-চোপড়সহ অনেক কিছু সহযোগিতা করেছেন। এলাকার মানুষ গর্ব করে তার সম্পর্কে বলেন, “আমাদের আলী ওসমান স্যার একজন আদর্শ শিক্ষকই নয়, তিনি একজন সাদা মনের মানুষ। স্কুলে সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও এলাকার সকল লোক তাকে সম্মান করে। অন্য শিক্ষকের চেয়ে তিনি ভিন্ন রকম মানুষ।’ শিক্ষক আলি ওসমান বলেন, “আমি নতুন করে অনেক কিছুই ভাবতে শিখেছি। আমার পরিবেশ, আমার স্কুল ও শিক্ষার্থীদের জন্য আমাকে নতুন কিছু করতে হবে, যাতে তারা পড়া লেখার পাশাপাশি নিজের পরিবার, পরিবেশ ও সমাজের জন্য কিছু করতে পারে। এ বছর আমি আমার স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাহায্যে নিজের বাড়ি, রাস্তা ও বাজারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। সকল শিক্ষকরা হোম ভিজিটও করেছিল। এতে বেশ সাড়া পাওয়া গেছে। আগামীতেও আমি এ ধরণের কার্যক্রম পরিচালনা করবো। আসলে আমি দেখাতে চাই একজন শিক্ষার্থী শুধুমাত্র পড়ালেখাতেই দক্ষ হবেনা, সে সকল দিকে পারদর্শী হবে।”
বারসিকের কাজগুলো সম্পর্কে শোনার পর তিনি পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় একটি পরিকল্পনা করেছেন। পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, “স্কুলে পরিবেশ সুন্দর রাখার জন্য বৃক্ষরোপণ (ঔষধি গাছ, স্থানীয় জাতের ফলের গাছ, তালগাছ রোপণ), প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় শিক্ষার্থীদের শপথ করানো, ভিডিও ডকুমেন্টরি প্রদশর্নী, শিক্ষার্থীদের বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরির্তন মোকাবেলা, জেন্ডার সমতা, নিরাপদ খাদ্য, অচাষকৃত উদ্ভিদের পরিচিতি এই কাজগুলো করলে শিক্ষার্থীদের জেনেরাল নলেজ বাড়বে এবং তাদের মধ্যে এগুলো চর্চা ও সংরক্ষণের মানসিকতা সৃষ্টি হবে।”
শিক্ষক আলী ওসমান এর অবসর সময় কাটে গান শুনে ও বই পড়ে নেত্রকোনার লোক সংগীত তিনি খুব ভালোবাসেন। তিনি আমাদের শিক্ষাগুরু, তার জীবনের সকল কাজগুলো আমাদের প্রেরণা দেয়। শিক্ষক আলী উসমান এর ন্যায় শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক প্রতিটি গ্রামে ও স্কুলে গড়ে উঠলে এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে শিক্ষার প্রকৃত আলো জ্বলবে। আমরা শিক্ষক আলী ওসমানের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।