প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করি, প্রাণবৈচিত্র্য বাঁচাই
নেত্রকোনা থেকে ফরিদুর রেজা খান নাফিস
নেত্রকোনা জেলা প্রাণের বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি জেলা হিসেবে পরিচিত। এখানে নদী, হাওর, পুকুর, খাল, বিল, বন, পাহাড়, জলাভুমির বিস্তৃতি ব্যাপকতা জানান দেয় যে, প্রাণচৈত্র্যপূর্ণ একটি জনপদ। কিন্তু দিন দিন এই প্রাণ প্রকৃতির বিলুপ্তি, বিনাশ, দখল, ভরাট, প্রশাসন ও জনগণের উদাসিনতা ও সহিংসতায় বিপন্ন হতে চলেছে। নদী হারিয়ে যাচ্ছে, পুকুর ভরাট করে প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, হাওর বিল ভরাট হচ্ছে। কৃষি জমিতে হচ্ছে বাড়িঘর, হাটবাজার, ইটখলা, রাইসমিল, মাছের চাষ, গরু মোটাতাজাকরণের খামার। বন কেটে পরিস্কার করা হচ্ছে। পাখি কমছে। মানুষ বাড়ছে। বাড়ছে দূষণ। বাতাস ভারী হচ্ছে কার্বনে।
আমরা দেখছি, ভূগছি। কিন্তু আমাদের যুব সমাজের কি কিছুই করার নেই? আমাদের জাগ্রত হওয়া এখনই প্রয়োজন। এ দেশটা আমাদেরই। স্বাধীন দেশটাকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারিনা। পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হুমকির মুখে বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্য।
দেশের ১০৬ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ১৩৭ প্রজাতির প্রাণী নানা পর্যায়ে বিপন্ন। যার প্রভাব আমাদের নেত্রকোনা অঞ্চলেও বিদ্যমান। পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনগুলোর গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাগুলো বলছে, পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এমন মেরুদন্ডী প্রাণীর সংখ্যা ১০। আগামীতে এই সংখ্যা আরো দীর্ঘ হবে। আমাদের আশঙ্কা আগামী দুই দশকে দেশের ২৫ শতাংশ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত বা বিপন্ন হয়ে যাবে। প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, গত কয়েকবছর ধরেই ক্রমাগত পরিবেশ প্রাণীকূলের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। জলাভুমি কমে যাচ্ছে, বন বিলুপ্তি, নগরায়ণ, কৃষিজমি কমে যাওযা, বিষ, কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বাতাসে সীসার পরিমাণ বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে পরিবেশ ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে। এমনকি অতি সম্প্রতি বয়ে যাওয়া দাবদাহের মতো ঘটনাগুলোও পরিবেশে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এসব কারণে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যই হুমকির মুখে রয়েছে।
আমি অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ক্ষমতায় আসা কোনো রাজনৈতিক দলই এসব বিষয়ে তেমন একটা কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। হয়তোবা এ অঞ্চলের মানুষ এসব প্রাণীদের নিয়ে ভাবে না, নতুবা এদের দিয়ে আমাদের কোনো দরকার নেই। কিন্তু পরম অপ্রিয় সত্য এই যে, পরিবেশের এসব প্রাণীর ক্রমাগত বিলুপ্তি মানেই বাংলাদেশের পরিবেশের বাস্তুুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদী একজন মানুষ। আমি অপেক্ষা করে আছি সে দিনটির জন্য যেদিন বাংলাদেশের আমলামন্ত্রীরা শকুন, বাঘ, বা স্থানীয়জাতের মাছ বিলুপ্তির বিষয়ে জনপ্রচারণা চালাবেন। অপেক্ষা করছি সেদিনটির জন্য যেদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী নদী দখলের বিরুদ্ধে সংসদে কথা তুলবেন। শহরের খাল দখল নিয়ে কেন সরকার ভাবছে না এমন দাবিতে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার আমরণ অনশন হবে।
বাঙালির জীবনে সব সময়ই স্বপ্ন একটা আবেগের জায়গা, বাঙালি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে-এমনি ভালোবাসে স্বপ্ন দেখাতেও। ব্যক্তিগত কৌতূহল মেটাতে পড়াশোনা থেকে প্রাণীর বিলুপ্তি সম্পর্কে যা জানতে পেরেছি, আমার মনে হয় এদের রক্ষায় খুব বড় একটা উদ্যোগ নেয়া উচিত। এরকম একটা আন্দোলন হোক এসব প্রাণীদের রক্ষার জন্য যে আন্দোলনের বাতাস সারা বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাবে। যে আন্দোলনের ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে দেশের ছেলে বুড়ো আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই রাজপথে বসে একসাথে কোরাস গাইবেন। এরকম একটি আন্দোলন যে আন্দোলনের বাতাস আসবে ঝড় হয়ে, কিন্তু যাওয়ার সময় কোনো এক বর্ষার স্নিগ্ধ বাতাস হয়ে, যে বাতাসের জন্য অপেক্ষায় থাকেন সাহিত্যপুত্র কবিরা!