হারিয়ে যাচ্ছে বটগাছ
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম শহিদ
আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত একটি নাম “বৃক্ষ রোপণ” অথচ যাকে কেন্দ্র করে এ নামটি ব্যবহার করে থাকি তাকে আমরা ভূলতে বসেছি। বাণিজ্যিকভাবে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গাছ রোপণ করলেও বর্তমানে বটগাছ রোপণের তেমন কোন উদ্যোগ আর আমাদের চোখে পড়েনা। নিরবে উজাড় হতে চলেছে শতশত বছর ধরে টিকে থাকা আমাদের দেশীয় এ গাছটি। সাধারণভাবে বুঝে থাকি এ গাছ জ্বালানি আর কিছু কাঠের ব্যবহার ছাড়া তেমন কোন কাজে আসেনা। বটগাছের ফল আমরা খাই না, অতীতে মানুষের কাছে বৃক্ষের ছায়া অতি লোভনীয় ছিল কিন্তু বর্তমানে রাস্তার উন্নয়ন ও দ্রুতগামী যানবাহন হওয়ায় সেটার প্রয়োজনীয়তাও অনেক কমে গেছে। জীবন জীবিকার সংগ্রামে ছুটতে গিয়ে বাল্যকালে শিখে আসা কিছু বাক্য ভুলতে বসেছি। ভাবার সময় পর্যন্ত পাচ্ছিনা, যেমন- “আমাদের চার পাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ।” আরও শিখেছিলাম “মানুষ একা বাস করতে পারেনা” এই থেকে শুধু ভেবে ছিলাম একজন মানুষ অন্য মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারেনা। কিন্তু এটির অর্থ যে ব্যাপক, শুধু মানুষ নয়, আমাদের চার পাশের সৃষ্টির অনেক কিছুকে বুঝানো হয়েছে তা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুল ইউনিয়নের ছাতনিপাড়া গ্রামে কালীতলা নামক স্থানে একটি বটগাছ রয়েছে। এলাকাবাসীর মতে, প্রায় ২২৫ বছর বয়স হলেও আজও গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। পাশের জমির মালিকদের ফসলের ক্ষতির জন্য বিভিন্নভাবে গাছটি কাটার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গাছটির সাথে সেখানকার মানুষের সংস্কৃতি ও অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই কারণে গ্রামের মানুষরা সংগ্রাম করে আজও গাছটিকে টিকিয়ে রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে ঐ গ্রামের প্রবীণ সুপল উরাও (৮৫) বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে এখানে পূজা করে আসছি। আজ থেকে ১২-১৩ বছর আগে এই গাছটিও কেটে ফেলার সকল ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু রক্ষার জন্য গ্রামের মানুষ রাজশাহী জেলা শহরে গিয়ে মিছিল করেছি, ফলে আজও টিকে আছে গাছটি।”
তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌরসভার ময়েনপুর গ্রামে চোখে পড়ে একটি বটগাছ। গাছটির বয়স এখনও এলাকার মানুষ বের করতে পারেনি। যে জায়গায় বটগাছটি আছে সেই জায়গা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয়রা বলেন, ‘জায়গাটিতে দীর্ঘদিন থেকে এলাকার মানুষ দুই ঈদের নামাজ পড়েন। জায়গাটি ঈদগাহ্ হিসেবে পরিচিত। এলাকার ও সমাজের সকল মানুষ জায়গাটি ব্যবহার করেন। জায়গাটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের, কোন ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা নয়।’
বরেন্দ্র অঞ্চলে অতীতে বড় অনেক বটগাছ দেখা গেলেও বর্তমানে এর পরিমাণ অতি কম। কিছু টিকে আছে সেগুলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি জায়গা, ধর্মীয় স্থান ও হাট বাজারকে কেন্দ্র করে। ব্যক্তি মালিকানা জায়গায় যে সব বটগাছ ছিল তা উজাড় করে ফেলেছেন। এর কারণ সম্পকে জানতে চেয়েছিলাম আলোকছত্র গ্রামের আব্দুল মজিদ খানের (৫৫) কাছে। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য গাছের তুলনায় বটগাছ জায়গা নেয় বেশি। সেখান থেকে তেমন কোন উৎপাদন বা উপার্জন হয়না। বর্তমানে মানুষের মধ্যে বাণিজ্যিক চিন্তা বেড়ে গেছে। জায়গা ভাগ হচ্ছে মালিক বেশি, কিন্তু জায়গার পরিমাণ ভাগে কম হচ্ছে। অল্প জায়গা থেকে বেশি রোজগার করার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে ব্যক্তি মালিকানা জায়গার বটগাছ গুলো নিধন করা হচ্ছে।” তিনি বটগাছ সম্পর্কে আরও বলেন, ‘বটগাছ রক্ষায় সরকারিভাবে যেমন- নদী, খাল- বিল, খাড়ির পাড় ও পতিত জায়গায় রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তবেই সহজে এসব গাছ নিধন করতে পারবেনা। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সরকার, জনপ্রতিনিধি ও জনগণ উভয়ই এগিয়ে আসা প্রয়োজন।’
চাহিদা বাড়লে যোগানের সৃষ্টি হয়। চলতি বছরে রাজশাহী তানোর উপজেলার ফলদ ও বৃক্ষ মেলায় বটগাছের চারার সন্ধান করা হলে স্থানীয় নুসরাত নার্সারির মালিক আবুল বাসার বলেন, ‘বটগাছ কেউ কিনতে চায়না তাই আমরা চারাও উৎপাদন করিনা।’
বটগাছ সরাসরি আমাদের উপকারে আসে সেটা আমরা কম দেখতে পাই। কিন্তু এ গাছের ফল অধিকাংশ পাখির প্রধান খাবার। বটগাছ না থাকলে সেই এলাকায় বিভিন্ন ধরনের পাখির খাদ্য ও বসবাসের সমস্যা তৈরি হবে সেটা কে না জানি। যেমন টিয়া পাখি এসব বড় গাছের মগ ডালের গর্তে বাস করতেন। আজ টিয়া পাখির মত কিছু পাখি বৈচিত্র্য নিরবে কমে যাচ্ছে, সেটা দেখার সময় কি আমাদের আছে? পাখিরা যে ফসল সহ ফুল ফলের পরাগায়ণ ও বিভিন্ন গাছের বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে যাচ্ছে সেটা আমাদের প্রত্যেকের অজানা নয়। এমনকি বটগাছের আবিষ্কারক হচ্ছে পাখি, ফল খেয়ে মল ত্যাগের মাধ্যমে গাছটি তৈরি হয়। গাছ সাধারণত মানুষেরই নয়, সকল প্রাণির জন্য অক্সিজেন প্রদান করেন। এ সকল বড় গাছ আবহাওয়া, জলবায়ু, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, ঝড় ও বজ্রপাত প্রতিরোধসহ বিভিন্নভাবে যে আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত তা সকলেই উপলব্ধি করে থাকি। একটি বটগাছ শুধু গাছ নয়, এক একটি বাস্তুসংস্থান। আর এই বাস্তু সংস্থানের উপর নির্ভর করেই সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল প্রাণি মানুষও টিকে আছে। তাই বাঁচার জন্য এই উদ্যোগ মানুষকেই নিতে হবে।