পরিকল্পিত নগরী ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন নিম্ন আয়ের মানুষের অগ্রাধিকারভিত্তিক আবাসন
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
পরিবেশ সুরক্ষা ও পরিকল্পিত নগরীর জন্য নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবাদীরা। আজ ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি (২তলায়) সাগর রুনী মিলনায়তনে পবা ও বারসিক’র যৌথ আয়োজনে “নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন : পরিবেশ দূষণ ও পরিকল্পিত নগরী” -শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি জননেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য। সেমিনারে ধারণাপত্র উত্থাপন করেন নগর পরিকল্পনাবিদ মো. হিসাম উদ্দিন চিশতী ও মো. জাহাঙ্গীর আলম। আলোচনা করেন গবেষক পাভেল পার্থ, আওয়ামী বাস্তুহারা লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়ন রাশেদ হাওলাদার, বস্তিবাসী ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক কুলসুম বেগম, বস্তিবাসী অধিকার সুরক্ষা কমিটির সহ সভাপতি হারুনুর রশিদ, নুরুজ্জামান প্রমূখ। উন্মুক্ত আলোচনায় ঢাকা শহরের বস্তিবাসীদের আবাসন সংকটসহ নানা বিষয়ে বক্তব্য রাখেন ঝুমুর আক্তার, ইয়ানুর বেগম, শাহিদা বেগম, রমজান আলী, রোমান হোসেন প্রমূখ। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন পবার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘ঢাকা নগরের তিনভাগের একভাগ মানুষ বস্তিবাসী ও ভাসমান যারা এই নগরকে সচল রাখে কিন্তু এই নগর তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। একের পর এক বস্তি উচ্ছেদ, অগ্নিকান্ড, হামলা করে বস্তিবাসীদের বিতাড়ন করা হয়। তাই সরকারের উচিত তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বস্তিবাসীদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলেও নিজেদের সংগঠিত করতে হবে এবং দাবি তুলে ধরতে হবে।’ আবুু নাসের খান বলেন, ‘পরিকল্পিত নগরী গড়ে তুলতে হলে বস্তিবাসীদের এই পরিকল্পনার বাইরে রাখলে চলবেনা। বস্তির সাধারণ মানুষরাই এই নগরের সকল কিছুই পরিচালনা করেন। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বস্তিবাসীদের পরিকল্পিতভাবে আবাসন সুবিধার মধ্যে আনতে হবে। অপরিকল্পিত আবাসন এই শহরের পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। তাই বস্তিবাসীসহ সকলের জন্যই পরিকল্পিত আবাসনের কোন বিকল্প নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন ও পরিবেশ সুরক্ষার্থে বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে।’
সেমিনারের ধারণাপত্রে ও বক্তারা বলেন, পরিবেশ বিপর্যয় ও নগর দারিদ্র ঢাকার জনজীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চকবাজারের নিদারুণ অগ্নিকান্ডের যন্ত্রণা আমাদের আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একের পর এক ঘটে যাওয়া নানা বিপর্যয় ঢাকাকে ক্রমশ সকলের বসবাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। নদী, খাল ও বৈচিত্র্যময় বাস্তুসংস্থানের ভেতর গড়ে ওঠা পৃথিবীর এই প্রাচীন নগরী আজ সামগ্রিক বিবেচনায় ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ আমরা এই নগরের প্রাণের স্পন্দনকে গুরুত্ব দিইনি। এই নগরের প্রাণ আছে। মাটি, পানি আর বাতাস এই নগরেরও দরকার। কিন্তু আমরা এই নগরের জীবন থেকে তার শৈশব, কৈশোর ও দুরন্ত যৌবন কেড়ে নিয়েছি। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা নদীকে আমরা নির্দয়ভাবে নিঃশেষ করেছি। ঢাকার প্রাণধারা ১৯ খাল, এর উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্য, উদ্যান, উন্মুক্ত চত্বর, খোলা প্রান্তর, সড়ক কোনো কিছুই আমরা নিরাপদ রাখিনি। বিচারহীন দখল ও তীব্র দূষণে ঢাকা আজ স্তব্ধ। তবুও কোটি মানুষের প্রিয় এই নগর এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের নানা শ্রেণি পেশার আশা ও স্বপ্ন। এক ইঞ্চি জায়গাও যে শহরে আর ফাঁকা নেই সেই শহর বিস্ময়করভাবে এখনো প্রতিদিন জায়গা দিচ্ছে গ্রামহারা মানুষদের। নানাভাবে বিপর্যস্ত এই ঢাকায় গ্রামহারা দরিদ্র মানুষদের টিকে থাকা হয়ে ওঠছে আরো দূর্বিষহ।’
বক্তারা জানান, আরবান স্টাডিজ ২০০৫ সালের হিসাবমতে, মোট বস্তিবাসীর সংখ্যা ছিল ৩৪,২০,৫২১ জন যা ঢাকার মোট জনসংখ্যার ৩৭.৪%। গবেষণায় দেখা গিয়েছে ঢাকা শহরের অধিকাংশ বস্তি ব্যক্তি মালিকাধীন, বাকীগুলো সরকারী জায়গায় গড়ে উঠেছে এবং বেশ কিছু মানুষ ভাসমান অবস্থায় থেকে জীবনচালিয়ে যাচ্ছেন। এই সব বস্তিগলোর অধিকাংশ নগরের নদী, খাল, ও জলাভ’মির কাছে এবং শহরের প্রান্তীক এলাকায় অবস্থিত। এইসব বস্তির পরিবেশ অত্যান্ত নোংরা, অপরিচ্ছন্ন ও ঘিঞ্জি। এখানে পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা অপ্রতুল, নেই বর্জ্র ব্যবস্থাপণার কোন সঠিক পরিকল্পনা। গবেষণায় দেখা গেছে বস্তিতে প্রতিটি ল্যাট্রিন /টয়লেট গড়ে ১৫০-২০০ জন মানুষ ব্যবহার করে যা কোন ভাবেই স্বাস্থ্য সম্মত নয়।
বস্তির প্রায় সব ঘরই এক কক্ষ বিশিষ্ট। বস্তিতে অধিকাংশ পরিবারই এককক্ষ বিশিষ্ট টিনের কাঁচা ঘর বা রুম ভাড়া নিয়ে চার বা পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট্য পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসবাস করে। খাওয়া দাওয়া, কাপড় চোপড় রাখা, রান্নার জ¦ালানি রাখা, পরিবারের জিনিসপত্র রাখা সবই ঐ একটি ঘরের মধ্যেই করতে হয়। গ্রীস্ম, শীত ও বর্ষাকাল বস্তিবাসী মানুষদের জন্য এক একটি অভিঘাতের নাম কারণ এই সময় তারা গ্রামের মতো নগরেও বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকে। গরমকালে টিনের ঘরে বাস করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। ফলে গরমে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দেয়। বর্ষাকালে বৃষ্টি হলেই অধিকাংশ ঘরে ময়লাযুক্ত পানি উঠে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে এবং পরিবারের জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তাদের চলাফেরা এবং কাজকর্মের বিঘ্ন ঘটে। শীতকালেও তাদের ঘরে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে অনেক ধরনের রোগের সৃষ্টি করে। অর্থাৎ প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া তাদের তারা জানান, অল্প আয়, নিম্নমানের তৈলযুক্ত খাবার গ্রহণ, অসচেতনতা, চিকিৎসার অভাব এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার কারণে দ্রুতই তাদের স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। ফলে তারা ডায়রিয়া, কলেরা, জ¦র, কাঁশি, গ্যাস্টিক, হাঁপানি, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের আয়ের অধিকাংশ টাকা খরচ করে ফেলে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বস্তিবাসীরা যে আয়তনের জন্য ২৫০০-৩০০০ টাকা মাসিক ভাড়া দেয়, আয়তন ও অন্যান্য সুবিধা বিবেচনায় তা বনানী-গুলশানের এপার্টমেন্টের ভাড়ার চেয়েও তারা বেশি ভাড়া দেয়। ঢাকার প্রায় সব কটি বস্তিতেই স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, পয়োঃনিষ্কাশন এবং বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা নেই বরং আছে বিচারহীনতা এবং শোষণ। অন্যদিকে উচ্ছেদ সমস্যা বস্তিবাসী মানুষের আরেকটি আতংকের নাম। সম্প্রতি ঢাকার ভাষানটেকে থেকে প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে তাদের অমানবিকভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা অমানবিক কাজ। বস্তি নিয়ে বারসিকের গবেষণায় ২৩ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন উচ্ছেদের কারণে তারা বস্তি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। ঢাকা শহর পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল একটি শহর। এই শহরের বস্তিবাসীদের কেউ রিকশা ড্রাইভার, কেউ ছোট দোকানদার, হকার, গার্মেন্টস কর্র্র্র্মী, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল বয়, গৃহকর্মি, ঠেলাগাড়ী চালক, রং মিস্ত্রী, রাজ মিস্ত্রী, নির্মাণ শ্রমিক, বাবুর্চি, ফেরিওয়ালা, ফুল বিক্রেতা, ভিক্ষুক, দৈনিক শ্রমিক, ছোট চাকুরি, বুটিক কর্মি, কারখানা শ্রমিক, মেকানিক, দারোয়ান, গরু পালন, বর্জ্র ব্যবস্থাপনা, বালু শ্রমিকসহ হাজারো পেশায় যুক্ত থেকে তারা শহরটাকে সচল করে রেখেছেন কিন্তু রাষ্ট্র এই দরিদ্র জনগোষ্ঠির জীবনকে সচল রাখার জন্য উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপই নেয়নি।
বক্তারা আরও জানান, ঢাকায় বসবাসকারী সকল মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকোর জন্য সুন্দর আবাসন ব্যবস্থা এবং সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল বস্তিবাসীদের জন্য আবাসন নিশ্চিত করার কথা বিভিন্ন সময় বলেছেন। যদিও বস্তিবাসীদের জন্য সরকারিভাবে তৈরি করা প্রথম ভাষানটেক আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ব্যবস্থাপনায় সরকার পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তারপরও সরকারিভাবে আরো বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন তারা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করেন। কারণ ওয়াল্ড আরবান ফোরামের মুল কথাই হলোই ‘সবার জন্য নগর, সবাইকে নিয়েই নগর। সুতরাং নগরের বস্তিবাসীসহ সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা সরকারিভাবেই করতে হবে। পাশাপাশি শহরের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য সরকারি বেসরকারিভাবে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। এর জন্য দরকার শহরের ভেতরের খাল, নালা, পুকুর, পার্ক, খেলার মাঠ, জলাভূমি উদ্ধার, সংস্কার এবং সবার জন্য উন্মুক্ত করা। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার নদী অবৈধ দখলমুক্ত করতে কাজ শুরু করেছে। তবে এই কাজের জন্য নগরের বস্তিবাসী মানুষ যেন কোনভাবেই সমস্যার মধ্যে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। বস্তি এলাকাসহ ঢাকার সকল অঞ্চলের সামগ্রিক পানি নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দক্ষ করে গড়ে তোলা দরকার।