হিংসা বিদ্বেষ ভুলে আমরা এক কাতারে সামিল হই
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
প্রতিবছর দোলের ১২ দিন পর মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথীতে পাবনার চাটমোহরের নিমাইচড়া ইউনিয়নের করকোলা স্নান ঘাটে গঙ্গা স্নান করতে আসেন পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়াসহ আশ পাশের জেলা-উপজেলার হাজার হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী। গতকাল করকোলায় বারুণীর গঙ্গা স্নান রূপ নিল উৎসবে। হাজার হাজার শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অংশ নেন এ স্নানোৎসবে।
নদীর ঘাটে বাজছে ঢাক ঢোল। উলুধ্বনীতে মুখরিত সমস্ত এলাকা। কেউবা মন্ত্র জপছেন। কেউ সূর্য দেবতাকে উদ্দেশ্য করে দুহাত তুলে প্রার্থনা করছেন। পুরোহিতরা সাঁরি বেঁধে বসেছেন নদীর পাড় ঘেঁষে। কেউ ব্যস্ত অর্ঘ সাজাতে। কেউ স্নান করছেন আবার কেউ স্নান সেরে পার্শ্ববতী অস্থায়ী তাবুতে কাপড় ছেড়ে রোদে শুকিয়ে নিচ্ছেন। সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাড়াও এলাকার অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ দূর দূরান্ত থেকে এসে নদীর ঘাটের মেলা থেকে নিত্য ব্যবহার্য জিনিষ পত্র কিনছেন। সব মিলিয়ে এ বছর করকোলার গঙ্গা স্নান রূপ নিল উৎসবে।
চাটমোহর উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তর দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গার শাখা নদী গুমানীতে প্রতিবছর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী বারুণীর গঙ্গাস্নান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে হাজার হাজার পূণ্যার্থীর ভিড় জমে করকোলা গ্রামের স্নান ঘাটে। নদীর ঘাটে মেলা বসে। এ মেলায় জামাই পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, জিলাপী, পাপড়সহ অন্যান্য খাবার, দা, বটি, খুন্তি, ছুড়ি, মাটির তৈরি হরেক রকম পুতুল, ব্যাংকসহ গৃহকার্যে ব্যবহৃত নানান ধরণের উপকরণ পাওয়া যায়। দুধ থেকে তৈরি ঘোল মেলায় যোগ করে বাড়তি আকর্ষণ। মেলার অদূরে ঋষি পল্লী। এ মেলা উপলক্ষে ঋষি পল্লীতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে কয়েক দিন ধরে। মেয়ে জামাই নায়রে আসে। আসে অন্যান্য আত্মীয় স্বজনও।
এ মেলা বিষয়ে অষ্টমনিষা গ্রামের শ্রী বিষ্ট পদ শীল বলেন, ‘আমাদের পূর্ব পূরুষদের কাছে শুনেছি গঙ্গা স্নানের মাধ্যমে পাপ ধুয়ে মুছে যায়। পাপ মোচন ও পূণ্য লাভের আশায় আমরা গঙ্গা স্নান করে থাকি।’ গুনাইগাছার উজ্জ্বলা রাণী বলেন, ‘আমাদের পাপ মোচন ও মনের বাসনা যেন পূর্ণ হয় এ আশায় আমরা গঙ্গা স্নান করে থাকি। নিজেদের শুদ্ধ করি। হিংসা বিদ্বেষ ভূলে আমরা এক কাতারে সামিল হই।’ করকোলা গ্রামের ঋষি সম্প্রদায়ের প্রধান খিতিশ চন্দ্র দাস বলেন, ‘প্রায় চারশত বছর যাবত করকোলা গ্রামে গঙ্গা স্নান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। অসংখ্য নারী পুরুষ ভক্তবৃন্দ এখানে নিদৃষ্ট দিনে স্নান উৎসবে যোগ দিতে আসেন। মনোবাসনা পূরণে তারা ঈশ^রের কাছে প্রার্থনা করেন। এখানে আমরা গঙ্গা দেবীর পূজাও করে থাকি। পাশের ঋষি পল্লীতে তিন দিনব্যাপী কালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।’
চাটমোহর পৌর সদরের বালুচর মহল্লার গৌরাঙ্গ মহা প্রভূর আখরার পুরোহিত শ্রী প্রশান্ত কুমার বাগচী বলেন, ‘প্রতি বছর দোলের ১২ দিন পর মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথীতে করকোলা স্নান ঘাটে গঙ্গা স্নান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। চলার পথে, প্রাত্যহিক জীবনে আমরা জানা অজানায় পাপ করে থাকি। তাই পাপ মোচন ও শুদ্ধ হওয়ার প্রত্যয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গঙ্গা স্নান করে থাকেন। এক সময় এ এলাকায় সাড়ম্বরে বারুণীর গঙ্গাস্নান অনুষ্ঠিত হলেও নানা কারণে এখন তা জৌলুস হারাতে বসেছে।’