কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় অমিতা রানীর উদ্যোগ
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
একসময় বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিম উপকূলীয় এলাকার প্রায় প্রত্যেক বাড়িই ছিল এক একটি কৃষি বাড়ি। এ সকল কৃষি বাড়ির বাইরের দিক দেখলে বোঝা যেতো যে বাড়িতে কি কি আছে। প্রত্যেক বাড়িই ছিল প্রাণবৈচিত্র্য ভরপুর। বাড়িতে ছিল বিভিন্ন ধরনের সবজি, ফলজ, বনজ, ঔষধি গাছ এবং অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য। সাথে ছিল গরু, ছাগল, মহিস, হাঁস, মুরগি, কবুতর, বিড়াল, কুকুর ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বৈচিত্র্য। পরিবেশে ছিল নাম না জানা অজানা হাজার বেজারে প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্য। তবে কালের বিবর্তনে সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।
তবে গ্রাম বাংলার অনেক নারী ও পুরুষ তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে নির্জনে নিভৃতে এখনো বিভিন্ন প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় নিরলস ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তেমনি একজন নারী শ্যামনগর উপজেলার কালমেঘা গ্রামের ৪০ বছর বয়সের কৃষাণী অমিতা রানী। স্বামী গেীবিন্দ মন্ডল পাশ্ববর্তী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকুরী করেন। দু’ছেলে পড়াশুনা করেন। নিজের জমিজমা বলতে বসতভিটাসহ ৫ বিঘা জমি। তার মধ্যে প্রায় দেড় বিঘা বসত ভিটা। অমিতা রানী একজন শিক্ষিত কৃষাণী। তিনি বিএ পাশ করে নিজের সংসার দেখাশুনার পাশাপশি কৃষি কাজ করছেন স্বামীর ঐ দেড় বিঘা বসতভিটায়। আর এ ভিটায় তিনি নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ও সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তাঁর বসতভিটায় তিনি বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি উৎপাদন ও কৃষি কাজের পাশাপাশি লাগিয়ে রেখেছেন বিভিন্ন ধরনের ফলজ গাছ। অমিতা রানীর বাড়িতে আম, জাম, কাঠাঁল, নারকেল, পেয়ারা, বেল, জামরুল, কুল, লেবু, বাতাবি লেবু, ছবেদা, আমলকি, তাল, খেজুর,কদবেল, সুপারিসহ নানা ধরনের ফলজ গাছ আছে। পুকুরে আছে বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় মাছ পুটি, বেলে, রুই, কাতলা, সিলভার, শোল, টেংরা,লুচো, বাইন, তোড়া. খরকুল্লো, কাকড়া, ভেটকে, বাটা ও চিংড়ি। পুকুর পাড় ও ভিটায় বিভিন্ন জায়গায় আছে অচাষকৃত উদ্ভিদ, থানকুনি, হেলাঞ্চ, কলমি, আদাবরুন,গাদামনি, গিমে শাক, দুধশাক, পেপুল, কাথাশাক ইত্যাদি।
বিগত সময়ে মাঠ পর্যক্ষেণ ও আলোচনায় অমিতা রানীর কাছে তার বসতভিটায় বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ ও ফলজ গাছ, অচাষকৃত উদ্ভিদের ব্যবহার এবং এলাকার মানুসের সাথে সম্পর্কে বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিজের বাড়িতে এ মৌসুমী ফল নিজের পারিবারিক চাহিদা পূরণ করে, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করি। অনেকে আমার ভিটা থেকে অচাষকৃত উদ্ভিদ তুলে নিয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাড়িতে অন্যদের থেকে বেশি পরিমাণ ফল গাছ থাকায় বিতরণের পাশাপশি পাড়ায় বাজার দামের থেকে কম দামে এসকল ফসল বিক্রি করি। কারণ সবাই যাতে খেতে পারেন। আর এর জন্য গ্রামের মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। এছাড়াও সবজি চাষের ক্ষেত্রে প্রতিবছর বীজ সংরক্ষণ করি এবং তা গ্রামের কৃষক-কৃষাণীর মাঝে বিতরণ করি।’
অমিতা রানী এভাবে ফসল চাষের পাশাপশি গবাদী পশুও পালন করে থাকেন। বর্তমানে তাঁর ৫টি গরু, ১১টি হাঁস ও ৯টি মুরগি আছে। অমিতা রানী বলেন, ‘এভাবে গবাদী পশু পালন এবং বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদের মাধ্যমে বছরে সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে প্রায় ১২ হাজার টাকার মতো আয় হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে এ আয়টা বড় কথা নয় মানুষের বিভিন্ন উপকার করতে পারছি আমার উৎপাদিত এ ফসলের মাধ্যমে এটাই বড় পাওয়া। আর আমি সবসময় এটা করতে ভালোবাসি।’
সবদিক থেকে একথা বলা যায় যে, অমিতা রানী কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একদিকে যেমন তার পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে অপরদিকে আন্তঃনির্ভরশীলতা ও বৈচিত্র্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।