শ্যামনগরে দখলকৃত খাল অবমুক্ত এবং পুনঃখননের দাবি
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে গাজী আল ইমরান
অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি থেকে কৃষি ফসল রক্ষা, উপকূলীয় এলাকায় মিষ্টি পানি সংরক্ষণের জন্য খাস খালের স্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিল, দখলকৃত খাল অবমুক্ত এবং পুনঃখননের দাবিতে সিএনআরএস এবং বারসিক শ্যামনগর রিসোর্স সেন্টার এর সহযোগিতায় সংবাদ সম্মেলন করেছে সিডিও ইয়ুথ টিম এবং মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও কৃষকরা। গতকাল স্থানীয় জনগোষ্ঠী, কৃষক এবং সিডিও ইয়ুথ টিম’র পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ধানচাষী মো. জাহাঙ্গীর আলম।
জাহাঙ্গীর আলম তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা উপস্থিত শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কুলতলী, কচুখালী, জেলেখালি, মথুরাপুর, হরিনগর, উত্তর কদমতলা ও আশেপাশের গ্রামের দরিদ্র কৃষকগণ। আপনারা জানেন মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে ৯৫% এর বেশি জায়গায় বাগদা চিংড়ি চাষ হয়। কুলতলী, জেলেখালি, কচুখালী ও উত্তর কদমতলা গ্রামের মাঝে ধান চাষের ২টি বড় বিল আছে। আমাদের এই এলাকা এক ফসলি এলাকা। আমন মৌসুমে এই গ্রামগুলোর দরিদ্র পরিবারগুলো ধান চাষ করে থাকে। এই এলাকায় বাড়ির পাশের পুকুর ও খালের পানি দ্বারা সামান্য কিছু জমিতে বোরো মৌসুমে ধান ও সবজি চাষ হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা অবগত আছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে আমরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আবার কখনো অনাবৃষ্টি, কখনো অতিবৃষ্টি, আবার কখনো লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে এই ক্ষতির মাত্রাকে আরো তীব্রতর করেছে। এই সমস্ত দূর্যোগের মোকাবেলা থেকে আমরা বেঁচে থাকি। মাটির নিচের পানি লবণাক্ততার কারণে আমাদের বৃষ্টির পানি ও খালের পানির উপর নির্ভর করেই কৃষি ফসল চাষ করতে হয়। কিন্তু আশির দশকে খালগুলি স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া ও প্রভাবশালী লোকজনের দখলদারিত্বের কারণে ৯৫% কোন অস্তিত্ব নেই। কেউ দখল করে মাছ চাষ করছে আবার কেহ ভরাট করে ধান চাষ করছে। এতে করে অনাবৃষ্টির ফলে খাল থেকে পানি সেচ দেওয়া সম্ভব হয় না।’ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই খাল দখল করে ভরাট করার কারণে অতি বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই এলাকায় কুলতলী ও কচুখালী দুটি বৃহত্তর খাল খালের ৫০% এর বেশি স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া। কুলতলী খালের ৬ একর ৮৩ শতাংশ ৭ জন লোক নিয়ে মাটি ভরাট করে জমি তৈরি করে ধান চাষ করে। এখানে খালের কোন অস্তিত্ব বোঝা যায় না। জেলেখালি ও কুলতলী গ্রামের মজু ও বসন্ত নামের দুই জন লোক কুলতলী খালের ২ একর লীজ নিয়ে মাছ চাষ করে। বাকি অংশ মুক্ত অবস্থায় আছে তবে তা দখল প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। অতীতে এই খালের পানি দ্বারা ধান সেচ দেওয়া হতো ও খালে বিলে প্রচুর মিষ্টি পানির মাছ জন্মাতো।’
কুলতলী খালটি দখল করে ভরাট করার কারণে বন্যায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আবার অধিকাংশ বছর অনাবৃষ্টির কারণে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এই কুলতলী খাল লীজ মুক্ত করার জন্য স্থানীয় কৃষক অশোক কুমার বিশ্বাস বাদী হয়ে মামলা করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ মামলা চালাতে পারেননি। ফলে মামলাটি ওই অবস্থায় স্থগিত হয়ে যায়। এই খালটির নিচের অংশটি নিয়ে মাছ চাষ করার ফলে জলাবদ্ধ হয়। পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হয় না। আবার অনাবৃষ্টি হলে গ্রহীতারা ধান ক্ষেতে সেচ দিতে পানি দেয় না। নিচের অংশটি সিএনআরএস এর সহযোগিতায় সাতক্ষীরা সহ-ব্যবস্থাপনা নির্বাহী কমিটি ২০১৮ সালে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার পুনরায় খনন করে। শ্যামনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, চেয়ারম্যান ৭ নং মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ, চেয়ারম্যান ৯নং বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদ এই কাজ উদ্বোধন করেন। এই খাল খননের উদ্দেশ্য ছিল অনাবৃষ্টি হলে এখান থেকে কৃষি ফসলে সেচ দিবে আবার অতি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে প্রয়োজনমতো পানি নিষ্কাশন করা যাবে। এই কারণে মিষ্টি পানির প্রাকৃতিক বৃদ্ধি পাবে। ২০১৮ সালে এই খাল খননের ফলে বিলে প্রাকৃতিক মাছ ও বৃদ্ধি পেয়েছিল। দরিদ্র পরিবারগুলো এইখান থেকে মাছ ধরতেন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই এই খালটি আবার দখল হয়। বাঁধ দিয়ে সেখানে মাছ চাষ করা হয়।
এই বিলের পাশে কচুখালী খালটি অবস্থিত খালের ১০ একর ৪২ শতক তিন বছরের জন্য বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে এই বন্দোবস্ত দেওয়া শুরু হয়। এই কচুখালী খালের পানি দ্বারা সেচ দিয়ে ২০০২ সাল পর্যন্ত দরিদ্র কৃষক ধান চাষ করতেন। এরপর এই খালের উপর এর একটি বড় অংশ দখল করে চিংড়ি ঘের করা হয়। পরে আস্তে আস্তে এইখানে লবণ পানি উঠিয়ে লবণ পানির মাছ ও কাঁকড়া চাষ করা হয়। পরবর্তীতে গিয়ে লীজ দেওয়া হয়। অথচ আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি এই কচুখালী খালটি উন্মুক্ত। এইভাবে কুলতলী গ্রামের সালাম মেম্বারের বাড়ির নিকট কুলতলী খালের লীজ দিয়ে ভরাট করে ধান চাষ করা হয়। ফলে প্রায় প্রতিবছর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৮ সালে জলাবদ্ধতার কারণে ধানের ৫০% ফলন কম হয়েছে। কোন বছর একটু বেশি বৃষ্টি হলেই কৃষক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই কুলতলী ও আশপাশের বিলে অসংখ্য খাল ছিল। স্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে দখল করা হয়েছে অথবা প্রভাবশালীরা ভরাট করে বাড়ি তৈরি করেছে, মাছ চাষ অথবা ভরাট করে জমি তৈরি করে ধান চাষ করছে। যদি এই খালগুলো দখলমুক্ত থাকতো তবে বর্তমান অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, লবণাক্ততা বৃদ্ধির সময় দরিদ্র কৃষকেরা ভালোভাবে কৃষি ফসল ঘরে তুলতে পারতেন বলে মন্তব্য করেন অনেকে।