অক্ষর চিনি, ইতিহাস জানি ভাষাপ্রেম হৃদয়ে বুনি

নেত্রকোনা থেকে পার্বতী সিংহ ::

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড
শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদ- সেটা পৃথিবীর সব জাতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারেনা। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছে নানা রকম পদক্ষেপ, বাস্তবায়ন করছে নানা ধরনের কর্মসূচি: যেমন বিনামুল্যে বই বিতরণ, বৃত্তি, উপবৃত্তি, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষাসহ নানান কার্যক্রম। সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় সরকার এ বছরের মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষার ১০০% উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের কারণে গ্রামে শিক্ষার হার ও আগ্রহ বেড়েছে ঠিকই কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব শিশুদের শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। এখনও অনেক শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। অবকাঠামোর অভাব, শিক্ষার উপকরণ ও নিরাপদ পরিবেশের অভাব, গ্রামীণ আর্থসামজিক অবস্থা, শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা সম্পর্কে অস্পষ্টতাসহ নানাবিধ কারণে এখন পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় গুণগত মাত্রায় সব পর্যায়ের সব শিশুকে শিক্ষায় সম্পৃক্ত করা যায়নি। নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার তেলিগাতি ইউনিয়নে এখনও অনেক শিশু প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত। এই বঞ্চনা নানা কারণ থেকে তৈরি হয়েছে, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। এসব শিশুকে যদি শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব না হয় তাহলে বাংলাদেশ সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধাগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের অগ্রগতির যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া সরকারের একার পক্ষে অর্জন করা কঠিন। প্রতিটি সংগঠন, প্রতিষ্ঠান কিংবা নাগরিকের দায়িত্বই হচ্ছে শিক্ষা বিস্তারে স্ব স্ব অবস্থান থেকে সহযোগিতা করার। তবেই না বাংলাদেশকে একটি নিরক্ষরমুক্ত শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

এলাকা উন্নয়নে যুব সংগঠন
দিয়ারা, শ্রীরামপুর, আমাটি এলাকার কয়েকটি ছোট ছোট গ্রাম। নেত্রকোনার তেলিগাতি ইউনিয়নে অবস্থিত এই গ্রামগুলো শহর থেকে বেশ দূরে। স্বাভাবিকভাবে এই গ্রামে সুযোগ-সুবিধা বেশ অপ্রতুল। পানিসহ নানান সামাজিক সমস্যা সমাধানে সরকার বা বেসরকারি পর্যায় থেকে কার্যকরি কোন পদক্ষেপ সেভাবে খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না এই গ্রামগুলোতে। এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস কৃষিই যেখানে অবহেলিত সেখানে শিক্ষা স্বাস্থ্য বিনোদনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাই শিক্ষাক্ষেত্রেও এই গ্রামের মানুষ পিছিয়ে রয়েছে। এমতাবস্থায়, গ্রামের নানান সামাজিকসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে সহযোগিতার জন্য এই গ্রামের তরুণ-তরুণীরা গ্রামভিত্তিকভাবে গড়ে তোলে তিনটি পৃথক যুব সংগঠন যারা পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে এলাকার শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিবেশ বিষয়ে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। এক্ষেত্রে উন্নয়ন সংগঠন হিসেবে বারসিক তাদের সেই উদ্যোগ-প্রচেষ্টাগুলোকে বাস্তবায়নে সহায়কের ভূমিকা পালন করে আসছে। যুব সংগঠনের সদস্যরা গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সাথে আলাপ আলোচনা করে ও নিজেদের উপলব্ধি থেকে গ্রাম উন্নয়নের বাধাগুলোকে চিহ্নিত করে এবং তা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে তারা গ্রামের সকলের সহযোগিতায় সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করে। এভাবে আলোচনার প্রেক্ষিতেই গ্রামের শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে এই সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বলে রাখা ভালো যে, নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে কৃষিনির্ভর এই এলাকার শিক্ষার হার এমনিতেই কম। গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতির কম। যেসব শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় তারাও পাশ করার পর ঝরে পরে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় এবং উচ্চ বিদ্যালয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায়। তাই খুব কম সংখ্যক ছেলে মেয়েই উচ্চ শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে।

শিক্ষায় সচেতনতা তৈরি ও শিক্ষা সহযোগিতায় যুব সংগঠন
এলাকার শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে শ্রীপুর ও দিয়ারা গ্রামের যুব সংগঠনের কয়েকজন শিক্ষিত অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করে বেশ কয়েক বছর থেকে। তারা স্কুল থেকে ঝরে পরা যুবক, লেখাপড়ার আকাঙ্খা আছে এমন যুবক, মেয়ে এবং শিশু চিহ্নিত করে। এসব শিশু ও যুবকদের অভিভাবকদের সাথে সংগঠনের সদস্যরা আলোচনা করে, শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করার চেষ্টা করে। যুব সংগঠনের সদস্যরা মেধাবী শিশুরা যাতে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে পারে কিংবা যারা পড়তে চায় না তারা যেন পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে সেজন্য তারা বিভিন্ন পর্যায়ে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করে, শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করে, নিজ উদ্যোগে লেখাপড়ায় দুর্বল শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে যতœ নেওয়া শুরু করে, দরিদ্র শিক্ষার্থীদৈর উপকরণ (খাতা, কলম) দিয়ে সহযোগিতা করে এবং লেখাপড়ার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করে। মেয়ে শিশুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে যাতে কোন ধরনের হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য সংগঠনের সদস্যরা স্থানীয় প্রশাসন, সমাজের গুরুস্থানীয় মানুষের সাথে আলোচনা করে একটি নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করে। এভাবেই এলাকার যুব সংগঠনের সদস্যরা সমাজের বিভিন্ন মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করে। তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিলকবরী কৃষক সংগঠন, উৎসুক কিশোরী সংগঠন ও নিবেদিতা যুব সংগঠনের যুবকরাও এলাকার শিশুদের শিক্ষা হার বৃদ্ধিতে নানা ধরনের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা গ্রহণ করে।

অক্ষর চিনি, ইতিহাস জানি ভাষাপ্রেম হৃদয়ে বুনি
শিক্ষা বিষয়ক সচেনতা তৈরির অংশ হিসেবে শিশুদের স্কুলমূখী করার জন্য যুব সংগঠনের সদস্যরা তিলকবরী কৃষক সংগঠন, উৎসুক কিশোরী সংগঠন ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় অক্ষর পরিচিতি কর্মসূচি অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করে এবং সেটা মহান ভাষা দিবস ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারিতে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে এই অনুষ্ঠান করার উদ্দেশ্যই ছিলো নিজ ভাষার প্রতি শিশুদের ভেতরে ভালোবাসা ও অনুরাগ তৈরি করা এবং ভাষার জন্য বাঙালি জাতির মহান আত্মত্যাগের ইতিহাস তাদেরকে জানানো ও প্রভাবিত করা। এভাবে অনুষ্ঠানের দিনে গুণীজনরা বাংলা ভাষার ইতিহাস, মহান একুশের তাৎপর্য এবং বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে কোমলমতি শিশুদেরকে জানান, শোনান। এছাড়া তারা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে বর্ণমালা তৈরি, যুক্ত বর্ণ প্রতিযোগিতা, দেশাত্মবোধক গান, কবিতা আবৃত্তির প্রতিযোগিতা ও প্রভাত ফেরী আয়োজন করে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে স্কুল প্রাঙ্গণে অবস্থিত শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরীর মাধ্যমে পলাশ ফুলের তোড়া সাজিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ৪টি গ্রামের প্রায় ৫০০ জন শিশু, অভিভাবক, শিক্ষক, যুবক, কৃষক, কিশোর কিশোরীরা। গ্রামের উৎপাদিত শস্যদানা দিয়ে বর্ণমালা তৈরিতে শিশুদের সহযোগিতা করে এলাকার উদ্যোগী যুবকরা। অভিনব উপায়ে অক্ষর তৈরির সৃজনশীলতার প্রতিযোগিতায় শিশুরা অংশ নেয়। অংশ নেয় যুক্তবর্ণ ও দেশাত্মবোধক কবিতা আবৃত্তির প্রতিযোগিতাতেও। এভাবে তারা অক্ষর চেনে, ইতিহাস জানে এবং পরস্পরের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। শিশুরা মনের সৌন্দর্য দিয়ে অঙ্কন করে অ, আ, ক, খ এবং শস্যদানা দিয়ে অঙ্কিত সেই অক্ষরগুলোকে অলংকৃত করে। তাদের মানসপটেও ভাষার প্রতি, দেশের প্রতি এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং অনুরাগের বীজ অঙ্কুরিত হয়। এই প্রসঙ্গে শিশুদের উদ্দেশ্যে শিক্ষক মো. মোতালিব হোসেন বলেন, “দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পেরেছি। তোমরা বর্ণ তৈরিতে নিজেদের সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছ। আমরা আমাদের ভাষাকে এভাবেই চর্চার মাধ্যমে রক্ষা করব। এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য এলাকার উদ্যোগী যুব সমাজকে এলাকার সকল মানুষের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই।” নিবেদিত সংগঠনের সভা প্রধান শাকা মাহমুদ বলেন, “তোমরা আমাদের নতুন প্রজন্ম। তোমরা সুস্থ ও সুন্দরভাবে গড়ে উঠলেই আমরা একটি সুন্দর সমাজ পাব। উৎফুল্লতার সাথে সবার অংশগ্রহণ আমাদের অনেক আশাবাদী করেছে। নিজেদের সংস্কৃতিকে চর্চার মাধ্যমে রক্ষা করতে হবে।”

উল্লেখ্য যে, এলাকার যুবকরা শুধু শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, বরং এলাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধান, স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তাঘাট মেরামত, এলাকা উপযোগি ফলজ গাছের বনায়ন, এলাকার সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এছাড়া এলাকার বিভিন্ন ঐহিত্যময় খেলাধুলাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা গ্রামে গ্রামে নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করে।

happy wheels 2

Comments