আগে বাহিরের মানুষ আসতো এখন আমরা বাহিরে যাই
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
‘আগে আমাদের এলাকাতে কোন পানির সমস্যা ছিলো না। সুপেয় পানি ছিলো পর্যাপ্ত; প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে সুপেয় পানির আধার ছিলো। আমরা শুধু মাত্র খাওয়ার পানিটা আমাদের গ্রামে যে পিএসএফ লাগানো যে পুকুর ছিলো সেখান থেকে নিয়ে আসতাম। এছাড়াও সবজী চাষ ও গবাদী পশু এবং রান্না বান্না করার পানি ছিলো আমাদের পুকুর গুলোতে। এসময় আমরা যেমন বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলাতে পারতাম তেমনি নানান ধরনের গবাদী পশু পাখি পালন করতে পারতাম। শুধু যে পানির জন্য সব কিছু পরিবর্তন হতে পারে তা এখন বুঝতে পারছি। এখন নেই তেমন গবাদী পশু-পাখি, ধান তো আর মোটে হয় না আর অল্প কিছু সবজী চাষ হয় তা শুধু বর্ষার সময়- অন্য সময় চেষ্টা করি ঠিকই, কিন্তু তা ভালো হয় না। আগে আমাদের গ্রাম থেকে বাহিরের গ্রামের মানুষ পানি নিয়ে যেতো আর এখন আমরা যাই বাহিরে।’
উপরোক্ত কথাগুলো বলেন শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের জাওয়াখালী গ্রামের কৃষানী অনিমা রানী মৃধা। গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে জাওয়াখালী কৃষি নারী সংগঠনের উদ্যোগে ও বারসিক’র সহায়তায় কৃষানী শেফালী বেগমের বাড়িতে এলাকার পানিয় জল ও পানির পরিস্থিতি নিয়ে গ্রাম পর্যায়ে এক আলোচনা সভায় কথা গুলো বলেন তিনি। আলোচনা সভায় জাওয়াখালী, গুমানতলী গ্রামের কৃষক-কৃষানী, শিক্ষার্থী ও বারসিক কর্মকর্তা সহ ৫ জন পুরুষ ও ২৬ জন নারী সহ মোট ৩১ জন অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারীদের নিকট এলাকার সুপেয় পানির সমস্যা কি কি? সমস্যা সমাধানে তাদের গৃহিত উদ্যোগ সমুহ কি কি এবং কিভাবে তা মোকাবেলা করছে তা জানার চেষ্টা করা হয়।
অংশগ্রহণকারী বলেন, আামাদের পানির সমস্যা সবচেয়ে বেশি। সুপেয় পানি না থাকার কারণে আমাদের নানান ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এখন আমরা আমাদের সুপেয় পানির অভাব দূর করছি অনেক দূর থেকে পুকুরের পানি সংগ্রহ করে, পানি ক্রয় করে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে। আর এ পানি সংকট থাকার কারণে আমাদের খরচের মাত্রা দিনদিন বাড়ছে। একদিকে যেমন পানি ক্রয় তেমনি আবার পানি সংরক্ষনের জন্য নানান ধরনের উপায় খুঁজতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত পানি সংরক্ষনে জন্য কলস, বালতি, হাড়ি, জগ, মাটির মেটে, ড্রাম, পলিথিন, ক্যারেট, বোয়াম, ট্যাংক এর সাথে প্লাস্টিকের নানা ধরনের বোতল ব্যবহার করতে হচ্ছে। আমরা জানি প্লাস্টিকের জিনিস ভালো না তার পরেও আমরা এগুলো বেশি ব্যবহার করছি। আর এর কারণ হলো খরচ কমানো এবং প্লাস্টিকের পণ্যগুলো সহজে নষ্ট হয় না ও পরিবহন করা সুবিধা।
তারা আরো জানান যে, দিনে পানি সংগ্রহ করতে কোন দিন ২ বার আবার কোন দিনে ৩ বারও যেতে হয়। আর এ পানি সংগ্রহের কাজটা আমাদের নারীদের বেশি করে করতে হয়। দিনে যে কতটা পানি লাগে তা বলা মুশকিল কারণ খাওয়ার পানি হয়তোবা পরিবারে একটু কম লাগে কিন্তু সাংসরিক অন্য কাজে অনেক পানি লাগে। পরিবারে শুধু খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে ৪০-৬০ টাকা লাগে। এখান থেকে ১০-১৫ বছর আগে আমাদের পানির সমস্যা ছিলো না। তখন পুকুরের পানি সরাসরি তুলে ফিটকিরি দিয়ে খেতাম আর সংসারে কাজেও এ পানি ব্যবহার করতাম। সম্পূর্ণ বদলে গেছে আমাদের পানির উৎস। আর তার মূল কারণ হলো লবণাক্ততা। এখন আমাদের গ্রামের চারিদিকে শুধু লবণ পানির চিংিড়ির ঘের। এছাড়াও চিংড়ি ঘের থাকলেও সেসব চিংড়ি ঘেরে নেই কোন আউটড্রেন যার জন্য অবাদে আমাদের বসতভিটায় লবণ পানি প্রবেশ করছে।
অংশগ্রহণকারীররা আরো বলেন যে, বর্তমানে আমরা যে পানি ব্যবহার করি তা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তার পরেও খেতে হচ্ছে কারণ পানি না পেয়ে আমাদের এই পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। আর এ পানি ব্যবহার করে আমাদের নানান ধরনের রোধ ব্যাধি হচ্ছে যেমন ডায়রিয়া, কলেরা, জ¦র, সর্দি কাশি, মাথা ব্যথা, ঘাঁ-পাঁচড়া, চুলকানি, এলার্জি, গলায় ব্যথা, শুকনা কাশি, মাজায় ব্যথা, গিটায় গিটায় ব্যথা হচ্ছে। এছাড়াও গবাদী পশুর ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানা, রানীক্ষেত, গুটি বসন্ত, উৎপাদন কম, ঘাড় বাঁকা, মাথা ফুলা, নালা পেট ফোলা নানান ধরনের রোগ ব্যাধি হচ্ছে।
সবশেষে অংশগ্রহণকারীরা তাদের সুপেয় পানির সমস্যা সমাধানে নিজেরা কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা জানান এবং কিছু সুপারিশ ও পরামর্শ প্রদান করেন। এলাকায় যে সুপেয় পানির পুকুর আছে তা পুনঃখননের উদ্যোগ গ্রহণ এবং সংরক্ষনের উদ্যোগ গ্রহণ, চিংড়ি ঘেরগুলোর আউট ড্রেন রাখা, গাজী ট্যাংক সহায়তা, ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন, সাপ্লাই পানির লাইন ব্যবস্থা করা হলে পানির সমস্যা সমাধান হতে পারে বলে তারা মনে করেন।