করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর লোকায়ত চর্চা
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে আল্পনা নাফাক:
বেঁচে থাকার জন্য মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম চিকিৎসা। মানুষ স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগবালাই প্রতিরোধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রকৃতিলব্ধ জ্ঞান নানান উপায়ে সন্ধান করে আসছেন। এসব স্থানীয় ও লোকায়ত নিজস্ব পদ্ধতি অবলম্বন করে তারা বেশ সফলও হচ্ছেন। আদিবাবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে লোকায়ত চর্চা ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা বেশি ব্যবহার করতে দেখা যায়। বিশেষভাবে পাহাড়ি ও বন এলাকার জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছের লতা, পাতা, ফল-মূলের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যা ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগ সফলতার সাথে মোকাবেলা করে জীবনযাপন করে আসছেন।
নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী একটি উপজেলা কলমাকান্দা। এ উপজেলায় বাঙালি, গারো, লিঙাম, বানাই ও হাজংসহ পাঁচটি জাতিস্বত্তার বসবাস। এর মধ্যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই বসবাস করে ভারত সীমান্তবর্তী পাহাড়ের পাদদেশে। আদিবাসীদের অধিকাংশই পাহাড়ের/বনের প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর। এ অঞ্চলের আদিবাসী ও বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীই তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং শারীরিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় চাষকৃত ও অচাষকৃত নানা ধরণের ফলমূল নিয়মিত খেয়ে থাকেন। করোনাকালীন সময়ে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্থানীয় ও লোকায়ত চর্চাগুলো সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা নিম্নে উপস্থাপন করা হল:
কলমাকান্দা উপজেলার খারনৈ ইউনিয়নের বামনগাও গোলাপ নারী সংগঠনের সভানেত্রী আকলিমা আক্তার করোনাকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজের লোকায়ত চর্চা সম্পর্কে বলেন, ‘করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা আদা, লবণ, লং এবং দারুচিনি পানিতে সেদ্ধ করে নিয়মিত পান করছি। প্রতিদিন তুলসি পাতা ও লেবু দিয়ে দুই/তিনবার করে লাল চা খাই। এছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমরা প্রতিদিন বৈচিত্র্যময় চাষকৃত ও অচাষকৃত খাবার খাচ্ছি। সর্দি, কাঁশি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা তুলসি পাতার রস, আদা ও মধু গরম পানিতে মিশিয়ে খাই। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে মসলা জাতীয় পানীয় ও খাবার খুবই উপকারী। তাই করোনাকালীন সময়ে মসলা জাতীয় পানীয় ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।’
সীমান্তবর্তী রানীগাও গ্রামের নারী সংগঠনের নেত্রী হাসিনা আক্তার বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে ছেলে-মেয়েদের যাতে ঠান্ডা না লাগে সে জন্য বিশেষভাবে যতœ নিচ্ছি। পরিবারের সকলকে নিয়ে প্রতিদিন দুই/তিন বার করে আদা, তুলসি পাতা ও মধু মিশিয়ে গরম পানি খাই।’ গ্রামের প্রবীণ লোকদের কাছ থেকে শুনে তারা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে এই চর্চাগুলো করে আসছেন বলে জানান হাসিনা।
করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় লোকায়ত চর্চা সম্পর্কে নয়াপাড়া গ্রামের আদিবাসী নারী সলিতা চিসিম বলেন, ‘তুলসিপাতা, আদা, লেবু, তেজপাতা, লং, এলাচি, দারুচিনি ও মধু মিশ্রিত গরম পানি পান এখন নিত্যদিনের ঘটনা। আগে শুধু জ্বর ও সর্দি-কাঁশি হলে আমরা এগুলো খেতাম। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমরা এগুলো নিয়মিত ব্যবহার করছি। এখন কোন ধরণের শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে নিজস্ব জ্ঞানে ভেষজ উদ্ভিদ দিয়ে ঔষধ তৈরি করে খাচ্ছি এবং বেশ উপকারও পাচ্ছি।’
দমদমা গ্রামের আদিবাসী নারী জোনাকী হাজং বলেন, ‘করোনা মোকাবেলায় আমরা প্রতিদিন তুলসি পাতা, আদা, তেজপাতা, থানকুনি পাতা পানিতে ফুটিয়ে দিনে তিন/চার বার করে নিয়মিত পান করছি। এছাড়াও সব সময় লবণ মিশ্রিত গরম পানি ও লাল চা খাই।’
খারনৈ গ্রামের সুরুজ মিয়া বলেন, ‘ ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে আমি খাড়াজোড়া পাতার রস পানিতে সামান্য চিনি মিশিয়ে খাই। শুধু রোগ প্রতিরোধে নয়, খাড়াজোড়া পাতার রস নিয়মিত খেলে বিভিন্ন রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচা যায়। তাছাড়া লং, এলাচি, দারুচিনি ও লেবু মিশানো গরম পানিতো আছেই।’ সুরুজ মিয়ার মতে, শুধু করোনাকালীনই নয়, এ চর্চাগুলো আমাদের নিয়মিত করা উচিত। তাহলে আমরা সব ধরণের রোগ-বালাই সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাব।
বগাডুবি গ্রামের প্রণতি হাজং করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষায় নিয়মিত লবণ মিশ্রিত গরম পানি পান করেন। তার মতে, গরম পানি এমনিতেই বিভিন্ন রোগবালাই উপশমে কার্যকরী। গরম পানি দিয়ে নিয়মিত গোসল করলে শরীরের বিষ ব্যাথা থাকেনা। করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় তিনি আদা, তেজপাতা, লং, দারুচিনি, কালোজিরা সিদ্ধ করে মধুর সাথে মিশিয়ে খান। এসব উপকরণগুলোর সব ক’টিই ঔষধিগুণ সম্পন্ন হওয়ায় বিভিন্ন রোগবালাই প্রতিরোধে খুবই উপকারী। এগুলো শুধু করোনাকালীন সময়ের জন্য নয়, সুস্থ থাকতে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এগুলো সকলেরই নিয়মিত ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করে আদিবাসী এ নারী।
মানুষ যুগ যুগ ধরে স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং বিভিন্ন রোগবালাই থেকে রক্ষায় প্রকৃতি থেকে লব্ধ জ্ঞান (লোকায়ত জ্ঞান) প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে চর্চা করে আসছেন। করোনাকালীন সময়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, বিশেষভাবে সীমান্তবর্তী পাহাড়ি ও বনাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা মোকাবেলায় লোকায়ত চর্চার কমতি নেই। তারা প্রাকৃতিক সম্পদগুলো লোকায়ত জ্ঞানের মাধ্যমে ব্যবহার করে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। করোনাকালীন সময়ে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিয়ে করোনা সংক্রমণের নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করে সীমান্ত ও পাহাড়ি এলাকার জনগোষ্ঠী লোকায়ত চর্চাগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।