বৈচিত্র্যময় সবজিতে ভরে গেছে হাওরের গ্রামগুলো

নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
নেত্রকানা জেলার পাঁচটি উপজেলায় কমবেশি হাওর রয়েছে। এসব হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ কৃষি জমি বছরের ৬/৭ মাস (মে-অক্টোবর) পানিতে ডুবে থাকে। এসময় হাওরের চারিদিক শুধু পানি আর পানি। হাওরের কৃষি ফসল বলতে শুধুমাত্র একক ফসল বোরো ধান ফলে। ধান ছাড়া হাওরের গ্রামগুলোতে তেমন কোন ফসলের চাষ হতোনা বললেই চলে। উঁচু জমিগুলোতে খুবই সামান্য পরিমাণে গোলআলু, মিষ্টিআলু, মরিচ ও মাসকলাই চাষ হত। ২০১৮ সালের পর থেকে হাওরাঞ্চলে বিশেষভাবে মদন উপজেলার মদন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের হাওর অধ্যুষিত গ্রামগুলোর কৃষক-কৃষাণীরা তাদের বসতভিটা ও উঁচু পতিত জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসল চাষ করছে।


২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে বারসিক মদন উপজেলার হাওরাঞ্চলে (মদন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন) কার্যক্রম আরম্ভ করে। মূলতঃ জলবায়ু সংকট জনিত ঝুঁকি হ্রাসে হাওরের জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় হাওরের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নির্ভর অভিযোজন ও প্রশমনে যেসব উদ্যোগ ও চর্চা রয়েছে সেগুলোকে সহযোগিতার মাধ্যমে শক্তিশালীকরণে বারসিক ২০১৮ সালে হাওরে কার্যক্রম আরম্ভ করে। কার্যক্রমের শুরুতে বারসিক’র কর্মীরা দু’টি ইউনিয়নের গ্রামগুলো পরিদর্শন করে দেখতে পায় হাওরে শীত মৌসুম/রবি মৌসুমে সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসল চাষের অনেক জমি থাকলেও তারা তাতে কোন ফসল করেনা। অগ্রহায়ণ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে হাওরের অনেক জমি থেকে পানি নেমে গেলেও কৃষকরা বোরো ধানের জন্য জমি পতিত ফেলে রাখে।

বারসিক শুরুতে গ্রাম পর্যায়ে উঠান বৈঠিক করে বসতভিটা ও উঁচু পতিত জমিগুলোতে বৈচিত্র্যময় সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসল চাষের জন্য কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করে। এছাড়াও বারসিক কৃষক নেতৃত্বে এলাকা উপযোগি বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের জাত নির্বাচনে গবেষণার জন্য হাওরের কৃষকদেরকে সহযোগিতা প্রদান করে।
গ্রামসভা ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ফলে কৃষক-কৃষাণীরা সবজি চাষে উৎসাহিত হলেও মানসম্মত বীজের অভাবে তাদের উৎসাহে ভাটা পরে। বারসিক’র পক্ষ থেকে কৃষকদের চাহিদার ভিত্তিতে হাওরের কৃষকদের মধ্যে বৈচিত্র্যময় ১৫ জাতের বীজ বিতরণ করা হয় এবং সেসব সবজি ও শস্য ফসলের বীজ সংরক্ষণের পরামর্শ প্রদান করা হয়। কৃষকরা বীজগুলো রোপণ করে ভালো ফলন পায় এবং বীজ নিজেরা সংরক্ষণ করেন।

অনুরূপভাবে ২০১৯ সালেও কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী ১৮ জাতের শস্য ফসলের বীজ সহযোগিতা করা হয়। কৃষকরা এসব বীজ নিয়ে চাষ করেন এবং বীজ সংরক্ষণ করে হাওর বীজঘরে বীজ ফের দেয়। ২০২০ সালে হাওরের অন্যান্য কৃষকরাও পতিত জমি ও বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষের জন্য বীজের চাহিদা জানায়। বারসিক ২০ জাতের সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসলের বীজ কৃষকদের সহযোগিতা প্রদান করলে তারা সেগুলো বসতভিটা ও পতিত জমিতে চাষ করেন। চলতি রবি/শীত মৌসুমে হাওরের বসতভিটা ও উঁচু জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসলের চাষ হয়েছে।


মদন উপজেলার হাওর অধ্যুষিত একটি ইউনিয়ন গোবিন্দশ্রী। ২০১৯ সালে গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের জন্য উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হয় এবং বছরের শেষ দিকে ৫০টি দরিদ্র পরিবারকে ঘরগুলো হস্তান্তর করা হয়। গুচ্ছগ্রামের ঘরগুলো হস্তান্তরের পর বারসিক গুচ্ছগ্রামের চারাপাশে পরিবেশ উন্নয়নে উপজেলা প্রশাসনের পরামর্শ অনুযায়ী বৈচিত্র্যময় ফল ও পানি সহনশীল গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বারসিক’র উদ্যোগে প্রথম পর্যায়ে ৫০টি পরিবারকে একটি করে থাই পেঁয়ারা ও উন্নত জাতের পেঁপে চারা প্রদান করা হয়। চলতি বছরে (২০২০ সাল) পরপর কয়েকবার বন্যা ও প্রচন্ড ঢেউয়ে গুচ্ছগ্রামের চারপাশের অনেক ভিটার মাটি ভেঙ্গে হাওরে পড়ে যায়। গুচ্ছগ্রামবাসী ভিটা রক্ষায় গ্রামের চারপাশে পানিসহনশীল গাছের বনায়নের জন্য বারসিক’র নিকট দাবি জানায়।

বারসিক’র সহযোগিতায় ২০২০ সালে বন্যা পরবর্তী সময়ে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) গুচ্ছগ্রামের চারপাশে ৫০০টি হিজল ও করচ এবং ৩০০০ মূর্ত্যা বেতের চারা রোপণ করে। পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে বসতভিটার সামান্য জমিতে সবজি চাষের জন্য বারসিক গুচ্ছগ্রামবাসীদের উৎসাহিত করে এবং বৈচিত্র্যময় সবজির বীজ বিতরণ করে। সবজি বীজ পেয়ে গুচ্ছগ্রামের ৫০টি পরিবার তাদের বসতভিটার সামান্য জমিতে (১.৫ শতক) বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেছে। উল্লেখ্য যে, প্রতিটি পরিবারকে ৩ শতক করে জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দেড় শতক জমিতে বাড়ি এবং দেড় শতক জমি সবজি চাষের জন্য। সরেজমিনে গুচ্ছগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সকল বসতভিটার চারপাশ বৈচিত্র্যময় সবজি যেমন- টমাটো, লাউ, মূলা, শিম, ডাটা, লালশাক, মিষ্টিকুমড়া, পুইশাক, চুকাই, করলা ইত্যাদি ফসলে ৫০টি পরিবারে বসতভিটা ভরে গেছে। গ্রামবাসীরা জানায়, তারা নিজেদের উৎপাদিত সবজি খাচ্ছেন, বাজার থেকে তাদের কোন সবজি কিনে খেতে হয় না, বরং কিছু কিছু সবজি বাজারে বিক্রি করছেন।


এই প্রসঙ্গে গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘সরকার গুচ্ছগ্রামের প্রত্যেক পরিবারের জন্য ৩ শতাংশ করে জমি বরাদ্দ দিয়ে তাতে দুই কক্ষের একটি ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। ঘরের অংশটুকু বাদ দিলে প্রত্যেকের ১.৫ শতক করে জমি থাকে। এ জমিগুলোতে কিছু হবে না বলে আমরা ফেলেই রেখেছিলাম। কিন্তু বারসিক’র কর্মীরা এসে আমাদেরকে এই জমিগুলো ফেলে না রেখে সবজি চাষের জন্য পরামর্শ ও বীজ দিয়ে সহযোগিতা করেন। আমরা বীজ পেয়ে নিজ নিজ ১.৫ শতাংশ জমিতে সবজি চাষ করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি লাউ, মূলা, লালশাক, ডাটা, বেগুন, করলা, পুইশাক ও চুকাই চাষ করেছি। নিজেরা খাওয়ার পর ৪০০ টাকার মূলা এবং ৭০০ টাকার লালশাক বিক্রি করেছি। কিছু লালশাকের গাছ বড় করছি বীজ রাখার জন্য। ক্ষেতে এখনও অনেক মূলা রয়েছে। মাঁচায় লাউ ধরতে আরম্ভ করেছে। লাউ খাওয়ার পরও বিক্রি করতে পারব। বারসিক পরামর্শ না দিলে হয়তো আমরা জমিগুলো পতিত ফেলে রাখতাম।’

আরেক গুচ্ছগ্রামবাসী ফজলুল হক তার বসতভিটার সামান্য জমিতে টমাটো, বেগুন, মূলা, করলা, লাউ, মরিচ ইত্যাদি সবজি চাষ করেছেন। টমাটো ও লাউ গাছে ফল ধরেছে, মূলা ফলতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে ফজলুল হক বলেন, ‘বারসিক থেকে বীজ পেয়ে আমি বসতভিটার ১.৫ শতক জমিতে ৬ জাতের সবজি চাষ করেছি। মূলাশাক আমরা খাচ্ছি, লাউ ও টমাটো খাওয়ার উপযোগি হয়েছে। আশা করি নিজেরা খাওয়ার পরও বাজারে বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করতে পারব। আমি করলা, বেগুন, লাউ ও মরিচের বীজ নিজেই সংরক্ষণ করব এবং গুচ্ছগ্রামের যেসব পরিবারের এসব বীজ নেই তাদেরও সেসব বীজ দিব।’

গুচ্ছগ্রাম ছাড়াও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের কৃষকরা (খালাসীপাড়া, সরকারহাটি, মাদ্রাসাপাড়া, বড্ডা, বারইঘড়িয়া, ইছাপাড়া, বোয়ালী, কদমশ্রী, শান্তিপাড়া এবং মদন ইউনিয়নের উচিতপুর, কুলিয়াটি, পশ্চিম কুলিয়াটি, দক্ষিণ মদন ইত্যাদি গ্রাম) তাদের বসতভিটা ও উঁচু পতিত জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসল (সরিষা, গম, খেসারী, মসুরী, ভূট্টা ইত্যাদি) চাষ করেছেন। উচিতপুর গ্রামের কৃষক বাবুল মিয়া, সিদ্দিক মিয়া, জামাল মিয়া, রোকেয়া বেগমসহ অনেক কৃষক-কৃষাণী বর্ষার পূর্ব সময় পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাওরের অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিগুলোতে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেছেন। উচিতপুর গ্রামের কৃষকরা জমিতে যেসব সবজি ও শস্য ফসলের চাষ করেছেন তার মধ্যে-মরিচ, লাউ, শিম, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, গোলআলু, পিয়াজ, রসুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, করলা, লালশাক, ডাটা, পুইশাক, পালংশাক, মূলা, বরবটি, ভূট্টা, শসা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব সবজি তারা ইতিমধ্যে বাজারে বিক্রি করতে আরম্ভ করেছেন। কৃষক বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমি ক্ষেতের পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে শীত মৌসুমের আগাম সবজি চাষের জন্য প্রস্ততি নিই। বর্ষা শেষের দিকেই আমি ঘরের পাশে স্থানীয় পদ্ধতিতে সবজির চারা তৈরি করে রাখি। পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষেত শুকালে ভালোভাবে চাষ দিয়ে চারাগুলো রোপন করি। চলতি মৌসুমে আমি ফুলকপি, বাঁধাকপি, করলা, লাউ, বরবটি, মরিচ ইত্যাদি সবজি চাষ করেছি। লাউ ও করলা বিক্রি আরম্ভ করেছি। সবজি বিক্রির টাকা দিয়ে আমি এক বছরের সংসারের খরচ জমা করি।’


কৃষাণী রহিমা আক্তার বলেন, ‘বারসিক আমাদের এলাকায় আসার পর থেকে আমরা অনেক জাতের সবজি চাষ করি। এ বছর আমি পিয়াজ, রসুন, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, ডাটা, মরিচ, লালশাক লাগাইসি। আমারমত গেরামের বেবাক মানুষ তারার বাড়িভিটা ও হাওরের কৃষি জমিত মেলা জাতের ফস (ধান ছাড়া অন্যান্য ফসল) কৃষি করসে। বেবাক বাড়িই দুল্লা কইরা (সানাম্য হলেও) অইলেও মরিচ আবাদ করসে নিজেরার লাইগ্যা। গেরামের প্রায় বাড়িই এহন আলি (বীজ) রাহে আর বীজঘরে আলি দেয়। আবার দরকার অইলে বীজঘরতন আলী নেয়।’


হাওরের জমিতে সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসলের ফলন অন্যান্য সমতল এলাকার চেয়ে যে কম ফলেনা সে বিষয়ে হাওরের কৃষকদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে। তারা তাদের সামান্য বসতভিটা ও কৃষি জমিতে তাদের সামর্থ অনুযায়ী বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে পরিবারের দৈনন্দিন সবজির চাহিদা পূরণ করতে পারছেন। আবার যাদের বসতভিটা ছোট এবং সবজি চাষের তেমন জমি নেই তারাও নিজস্ব পদ্ধতিতে (টাওয়ার পদ্ধতি ও ঘরের চালে) লতা জাতীয় সবজি চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছে। মদন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের প্রায় সকল কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে সবজি ও শস্য ফসলের বীজ সংরক্ষণ এবং পরস্পরের সাথে বিনিময় করার মানসিকতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে সবজি চাষ ও একমাত্র ফসল বোরো ধানের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন জাতের শস্য ফসলের (ভূট্টা, গম, সরিষা, মাসকলাই, ধনিয়া ইত্যাদি) চাষ বৃদ্ধির মাধ্যমে একদিন হাওরের কৃষকরা কৃষি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি হ্রাসে সক্ষম হবে। পাশাপাশি হাওরে বৃদ্ধি পাবে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের, আর হাওরবাসীর জন্য বৈচিত্র্যময় খাদ্য সুনিশ্চিত হবে। সুরক্ষিত হবে হাওরবাসীদের পুষ্টির ভান্ডার।

happy wheels 2

Comments