সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করতে চায় ঝুমা রবিদাস

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

আমাদের সমাজে আমরা বংশ পরিচয়কে বড় করে দেখি। কিন্তু নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করতে হলে বংশ বা পদমর্যাদা কোনো কাজে আসেনা। কারো ভেতর কোনো গুণাবলী থাকলে যেভাবেই হোক তা প্রকাশ পাবে। তেমনই একজন কিশোরী ঝুমা রবিদাস, নেত্রকোণা সরকারি কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের লক্ষীগঞ্জ গ্রামের রবিদাস পাড়ায় তার জন্ম। বাবা জুতো সেলাইয়ের কাজ করেন। কিন্তু এই পরিচয়ের বাইরে গিয়েও সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে সে নিজের পরিচিতি তৈরি করেছে।


ঝুমা রবিদাস চার ভাই বোনের মধ্যে তৃতীয়। খুবই দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। তাছাড়া শুধু দরিদ্রই নয়, তারা দলিত শ্রেণির। ঝুমার মা বাবা অবাঙালি দলিত শ্রেণির মানুষ। তবে বাংলা ভাষাতেও কথা বলতে পারেন। তাঁদের থাকার জন্য নিজেদের কোনো জায়গা নেই। লক্ষীগঞ্জ বাজারের দক্ষিণে মগড়া নদীর কোল ঘেঁষে সরকারি খাস জায়গায় রবিদাস সম্প্রদায়ের ১৬টি পরিবারের বসবাস। ঝুমার পরিবারও সেখানেই থাকে।


ঝুমার বাবা সামান্য জুতো সেলাইয়ের কাজ করেন। চার ভাই বোনের লেখাপড়ার খরচ চালাতেই তাকে হিমশিম খেতে হয়। এ অবস্থায় তার মা স্থানীয় লক্ষীগঞ্জ বাজারে চালের/ধানের, কাঠের মিলে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকে যা পায় তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে তাদের। এই অবস্থায় কোনো মেয়ের গান শেখা তাদের কাছে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।


অনেক ছোট বেলা থেকেই ঝুমার গানের প্রতি দারুণ আগ্রহ। কারো কাছে বা টিভিতে গান শুনে নিজে নিজে গাওয়ার চেষ্টা করতো। তখন পর্যন্ত কোনা শিক্ষকের কাছে গান শেখার সুযোগ পায়নি। সে যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে তখন তার স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রথম সুযোগ পায় গান করার। তার গান শুনে স্কুলের শিক্ষিকাগণ তাকে গান শিখতে উৎসাহিত করেন।


এর প্রায় বছর খানেক পর স্থানীয় বাজারে একজন সঙ্গীত শিক্ষক গান শেখানোর জন্য আসেন। পারিবারিক অনটন থাকা সত্ত্বেও ঝুমা গান শিখতে শুরু করে। মূলত তাঁর কাছেই ঝুমার গান শেখার হাতেখড়ি। বলরাম ওস্তাদের কাছে সে প্রায় চার বছর গান শেখে। অভাবের সংসারে অনেক কষ্ট করে শিক্ষকের বেতন দিতে হতো। কোনো মাসে দিতেও পারতোনা। তবে এর জন্য তার গান শেখায় কোনো সমস্যা হয়নি। সেই শিক্ষকের অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে ঝুমা ছিল ব্যতিক্রম। কারণ সে কোনো গান অতি দ্রুত আয়ত্ব করতে পারতো।

একদিকে দরিদ্র পরিবার অন্যদিকে দলিত শ্রেণি। সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কম। তাই ঝুমার মা মেয়েকে গান শেখানোর প্রতি কখনোই আগ্রহী ছিলেন না। এমনকি এখনো তাঁর ইচ্ছা নেই মেয়ে গান করুক। ঝুমা যতটুকু এগিয়েছে, পুরোটাই তার নিজের প্রচেষ্টায়। ঝুমার মা রেনু রবিদাসের ধারণা মেয়ে যদি বাইরে গিয়ে গান গায় তবে ভবিষ্যতে তাকে বিয়ে দেয়া যাবেনা। অনেক সমস্যা হবে। গান করা মেয়ে অনেকেই বৌ করে নিতে চাইবেনা।

ঝুমা যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে তখন প্রথমবারের মতো একটি গানের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। নেত্রকোণা শহরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে গান করে সে। হাতে গোনা ২/৩টি জায়গা ছাড়া খুব বেশি অনুষ্ঠানে সে অংশগ্রহণ করেনি। কারণ পরিবার থেকে সেই সুযোগ পেতো না। শুধুমাত্র তার নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অনুষ্ঠানে গান গাইতো।

নিজ এলাকার বাইরে গিয়ে যেহেতু সে গান করতে পারেনি তাই সে বাড়িতে থেকেই বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা ছেলেমেয়েদের গান শেখাতে শুরু করে। এভাবেই কয়েক বছর কেটে যায়। গান শেখানোর পাশাপাশি নিজের চর্চা ও পড়ালেখাটাও চালিয়ে যায় ঝুমা।
ঝুমার পূর্বের সঙ্গীত শিক্ষকের মাধ্যমে নেত্রকোণা শহরের বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার রানা তাজ এর সাথে পরিচয় হয়েছিল। দীর্ঘদিন পর ২০১৯ সালের শেষ দিকে রানা তাজ ঝুমার সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাকে গান শেখানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন।

কয়েক মাস আগে ঝুমা যখন রানা ওস্তাদের কাছে গানের চর্চা করছিল তখন এই শিল্পীর সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক আসেন। ওস্তাদ ঝুমাকে দিয়ে তাঁর লেখা ও সুর করা একটি গান পরিবেশন করিয়েছিলেন। সেই দিন থেকেই ঝুমার জীবনের পরিবর্তনের শুরু। চ্যানেলের সাংবাদিকগণ ঝুমার গান শুনে তার গান রেকর্ডিং করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। চলতি মাসের প্রথম দিকে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত ‘সুর পাগল’ নামক স্টুডিওতে ঝুমার ছয়টি গানের রেকর্ডিং হয়েছে। বর্তমানে তার দুইটি গান ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে। আগামী মাসে আবারো গানের রেকর্ডিং হবে বলে জানিয়েছে সে।


ঝুমা সব ধরণের গান গায়। যে কোনো গান একবার শুনেই হারমোনিয়মে তুলে নিতে পারে। যে গানগুলো তার রেকর্ডিং হয়েছে সবগুলোই রানা তাজ এর লেখা ও সুর করা।
পরিবার ও সমাজের অনেক বাধা অতিক্রম করে ঝুমা রবিদাস সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। অর্থ উপার্জনের জন্য নয়, নিজের আনন্দ এবং নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য গান গাইতে চায় সে। ছোট্ট এই সুযোগের হাত ধরে হয়তো ভবিষ্যতে ঝুমা আরো এগিয়ে যাবে।

happy wheels 2

Comments