প্রকৃতির বন্ধু মৌমাছি পালন ও মধু চাষে তরুণের সাফল্য
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
ভূমিকা
পরিবেশ ও প্রকৃতির অন্যতম বিশ^স্ত বন্ধু বলা হয়ে থাকে মৌমাছিকে। মৌমাছি শুধু প্রকৃতির ও পরিবেশর বন্ধুই নয়, মৌমাছি প্রাণীকূলেরও এক নির্ভরযোগ্য বন্ধু বটে। প্রাচীনকাল বা সৃষ্টির শুরু থেকেই মৌমাছি মানুষের খাবার তৈরির এক বিশাল দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে। আর এ জন্য হয়তো প্রাচীন গ্রিক পুরাণে মৌমাছিকে ‘ঈশ^রের দূত’ এবং মৌরস/ মধুকে ‘অমৃত’ আখ্যা দেয়া হয়েছিলো। ফুলপ্রেমী এই পতঙ্গটির উপর নির্ভর করছে গোটা পৃথিবীর টিকে থাকা আর না থাকা। গবেষকরা বলেছেন, মৌমাছি না থাকলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপক হারে ব্যাহত হবে। পরিশ্রমী আর সামজিক এই প্রাণীটি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্বের সাথে। হয়তো আমাদের চোখে পড়ে না কিন্তু কাজ করে যাচ্ছে নিরবে। আমেরিকার কর্নেল বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক স্কট ম্যাকআর্টের গবেষণায় জানা যায়, ‘মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ পরাগায়নের মাধ্যমে বিশ^জুড়ে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের ফসল উৎপাদনে সরাসরি অবদান রাখছে।’ মৌমাছি বা এই জাতের পতঙ্গ খাদ্য উৎপানে যে অবদান রাখছে তা হয়তো পরিসংখ্যানে আনা খুবই কঠিন বিষয়। কিন্তু খাদ্য উৎপদনে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই প্রাণীটি যে অসামান্য অবদান রাখছে তা বারবার বৈজ্ঞিানিক গবেষণায় প্রমাণিত। প্রাকৃতিকভাবে মৌমাছি মধু উৎপাদন করে থাকে। দিনে দিনে প্রাকৃতিক বন জঙ্গল কমে যাবার কারণে মৌমাছিও আর আগের মতো দেখা যায় না। মধুও উৎপাদন কম হয়ে থাকে। অন্যদিকে শস্য ফসলে ফলের বাগানে কীটনাশকের ব্যবহারের কারণে মৌমাছিসহ এরকম পতঙ্গ কমেছে মারাত্মক হারে। দিনে দিনে জনসংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় আমাদের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের উৎসগুলো কমে গেছে। তেমনি একটি যেমন মৌমাছি ও মধু সংগ্রহ। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিকভাবে মানুষ মৌমাছি পালন করে মধু সংগ্রহ করছে। পরিবেশবান্ধব এই উদ্যোগের কারণে যেমন পরিবেশ প্রকৃতির উপকার হচ্ছে তেমনি মধু সংগ্রহ করে মধুর যোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে। ব্যবসায়িকভাবে অনেকে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তেমনি একজন তরুণ তানোর উপজেলার আজিজুল হক।
আজিজুল হকের মৌমাছি পালনের ইতিকথা
শুরুটা ২০২০ সালের প্রথম দিকে। আজিজুল হক পেশায় একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। কাজ করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। উক্ত বছরের শুরু দিকে যখন চারদিকে করোনা মহামারির আতংক আর মৃত্যুর মিছিল ঠিক সেই সময়ে আবার লকডাউনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা আসে। কিন্তু সরকার শিল্প কলকারখানা খেলা রাখা বা শিথিলতার কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠানটি খোলা থাকে। এরই মধ্যে তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন নিজের বাড়িতে। বাড়িতে মাকে দেখতে আসবেন বলে কোন ছুটি দেয়নি সেই সময় তার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কোন কথা না শুনে তিনি বাড়িতে চলে আসন। একই সাথে সিদ্ধান্ত নেন তিনি নিজেই কিছু একটা করবেন। আর কোন চাকরি করবেন না। বাড়িতে বড় ভাইয়ের কাছে শিখে নেন কিভাবে মৌমাছি পালন করে মধু চাষ করা চায়। ২০২০ সালের মধ্যেই তিনি এই কৌশল আয়ত্ব করেন। এরপর ২০২১ সালে তিনি নিজেই মৌমাছি পালন করা শুরু করেন। প্রথমমত ১০টি বাক্সে তিনি মৌমাছি পালন শুরু করেন। সেই বাক্সগুলো ফুল আলা গাচের নীচে গিয়ে রাখেন। এভাবে সরিষা ফুলের খেতসহ বিভন্ন মৌসুমী বাগানের কাছাকাছি নিয়ে বাক্সগুলো রাখেন। বাক্স থেকে মৌমাছিগুলো মধু সংগ্রহ করে আনেন। প্রতি মাসে এভাবে তারঁ উৎপাদন বাড়তে থাকে। এভাবে দিনে দিনে এখন বর্তমান তাঁর বাক্স হয়েছে ৯০টি। প্রতিমাসে মধু থেকে তাঁর আয় এখন প্রায় লক্ষাধিক টাকা। আবহাওয়া বা পরিবেশ উপযোগী হলে আয়ের পরিমাণও বাড়ে। আবার মৌসুমে কোন সময় আবহাওয়া বা পরিবেশ খারাপ হলে মধু উৎপাদন কমে যায় কিছুটা।
আজিজুল হক বলেন, ‘মৌসুম ভিত্তিক গ্রামের বিলগুলোতে বিশেষ করে শস্য খেতে আশ পাশে খাচাগুলো রাখা হয়, বিশেষ করে যেসকল শস্য ফসলের ফুল হয় সে সকল ফুল থেকে মধু আহরণের জন্য মাছির বাক্সগুলো পাশে রাখা হয়।’ তাঁর মতে, যে এলাকায় আমাদের মৌমাছি নিয়ে যাওয়া হয়, সেই এলাকার শস্য ফসলের উৎপাদন বাড়ে। কারণ হিসেবে তিন বলেন, ‘মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলেল উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়।’
আজিজুল হক বলেন, ‘মৌমাছি পালন করে আমি যেমন নিজে স্বাবলম্বী হয়েছি, তেমনি এলাকার মানুষের ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘এক সময় অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম এখন নিজেই একটি ভালো কাজের সাথে যুক্ত হয়েছি। যেটা একান্ত নিজের। আমার সাথে আমি আরো একজন তরুণকে এই কাজের সাথে যুক্ত করেছি।’
মৌমাছি পালনে আজিজুল হকের পরামর্শ
আজিজুল হগকের মতে, অন্যান্য পেশার মতো মৌমাছি পালন ও মধু চাষ একটি অন্যতম পরিবেশবান্ধব লাভজনক ব্যবসা হতে পারে। প্রথমত কোন তরুণ বা কেউ আগ্রহী হলে তাকে এ বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা নিতে হবে। প্রথম পর্যায়ে মৌমাছি লালন পালন দিকগুলো জানা দরকার। যেহেতু এই মৌমাছির জাতটি ইন্ডিয়ান বা চায়না হয়ে থাকে সেহেতু এই জাতটি সম্পর্কে জানা থাকা জরুরি। বিশেষ এই মৌমাছির জাতটি খাচায় পালন করা যায়। এই জাতের মৌমাছি হিং¯্র জাতের নয়। সহজে কামড় দেয়না। সাধারণত বাক্স পরিচচর্যা এবং বাক্স তৈরি বা বাক্স ক্রয় করে শুরু করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘মৌমাছি চাষ সাধারণ আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। ভালো আবহাওয়া থাকলে এক মাসেই ২/৩ টন মধু উৎপাদন করা সম্ভব। মৌমাছির কিছু রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে সঠিক ট্রিটমেন্ট করলে সহজেই ভালো হয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণত বাংলাদেশের আবাহহওয়া ও শস্য ফসলের বৈচিত্র্যের কারণে জুনের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর এর মাঝামাঝি পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। স্থানীয় জলবায়ু এবং মৌমাছির জীবনের উপর নির্ভর করে মধু সংগ্রহের পরিমাণ নির্ধারণ হয়। আবহাওয়া খারাপ হলে মৌমাছির ডিম পাড়ার সময়সূচিতে তারতম্য দেখা দিয়ে থাকে। তাই এ বিষয়গুলো খেয়াল করতে হবে।’
আজিজুল হক বলেন, ‘যেকোন ব্যক্তি কয়েকদিন এই বিষয়ে অভিজ্ঞতাগুলো অর্জন করে সহজেই এই লাভজনক ব্যবসা শুরু করে দিতে পারেন।’ আজিজুল হকের মধুর চাহিদা এতোই যে মধু উৎপাদনের আগেই আগাম চাহিদা দেয়া থাকে অনেকের। তাই মধু বেচতে তাঁর সমস্যা হয়না।
উপসংহার
মৌমাছি পালন এবং মৌচাষ করে সহজেই যে কেউ এর থেকে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে পারে। গ্রামে বিশেষ করে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ফূলের সময় মৌমাচির বাক্স পাশে রেখে দিলেই সেখানে মৌমাছি বাক্সে মধু সংগ্রহ করা শুরু করে। প্রকৃতির বন্ধু মৌমাছি যেমন স্থানীয় শস্য ফসলনসহ ফল ফলাদির উৎপাদন বাড়তে সহায়তা করবে তেমনি নিজের একটি লাভজন পেশাও সৃষ্টি হবে। গ্রামের তরুণরা সহজেই এই কাজ করতে পারেন। এমনকি শহরের তরুণরাও এই কাজটি সহজেই করতে পারে।