সুজলা মার্ডি ও আঙ্গুরি বেগমের ক্ষতি পুষিয়ে দেবে কে?

বরেন্দ্র অঞ্চল-রাজশাহী থেকে মো: শহিদুল ইসলাম
স্মরণকালের ভয়াবহ খরা ও তীব্র তাপদহের কবলে পড়েছিলো রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চল। চলতি বর্ষা মৌসুমে এরকম অনাবৃষ্টি, তীব্র খরা আর তাপদহের কবলে কখনোই পড়েনি বরেন্দ্র অঞ্চল। স্থানীয় প্রবীণ এবং আবহাওয়া পর্যবেক্ষক দপ্তরের তথ্য মতে, এর আগে কখনোই বর্ষাকালে এরকম তীব্র তাপদহ আর অনাবৃষ্টির কবলে পড়েনি বরেন্দ্র অঞ্চল। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক গাউসুজ্জামান বলেন, ‘রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছরই তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বেশি। চলতি বছরে এই মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রী দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি বছর এপ্রিল মাসের এই তাপমাত্র বিগত বছরগুলোর তুলনায় বেশি। গোটা বর্ষায় কোন বৃষ্টি ছিলোনা। সময় মতো ধান রোপণ করতে পারেননি কৃষক। কাজের অভাবে শ্রমিকের ধার দেনা বেড়েছে। ঋণগ্রস্ত হয়েছে কৃষক এবং শ্রমিক।


তীব্র খরায় শুধু কাজের অভাব এমনটা নয়। এই খরায় বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের গবাদি পশু পাখির মৃত্যুও চোখে পড়ার মতো। রাজশাহীর তানোর উপজেলার মন্ডুমালা মিশন পাড়া গ্রামের সুজলা মর্ডি (৩৬) এর একটি ষাড় গুরু মারা গেছে। সুজলা মার্ডি বলেন, ‘তীব্র গরমে আমার প্রায় চল্লিশ হাজার টাকার একমাত্র গুরুটি মারা গেছে।” এছাড়াও এই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের কৃষকের হাঁস মুরগি গরু ছাগলও মারা গেছে তীব্র গরম ও দাপদাহের কারণে। পিরান পুকুর গ্রামের আঙ্গুরি বেগমের (৩৫) তিনটি ছাগল মারা গেছে তীব্র দাপদহের কারণে। বাকি তিনটি ছাগলও অসুস্থ হয়েছিলো। অনেক টাকা খরচ করে অবশেষে তিনটি ছাগল মোটামুটি ভালো হয়েছে। আঙ্গুরি বেগম বলেন- ‘অনেক কষ্ট করে ছাগল পালন করতে শুরু করি, আমার মোট ছয়টি ছাগল, ভেবেছিলাম এই ছাগগুলো বিক্রি করে জমি কট নিবো, ফসল ফলাবো, বাচ্চাদের মুখে খবার তুলে দেবো, কিন্তু দীর্ঘ একমাসের (আষাঢ় মাস) কঠিন গরমে-তাপের কারণে আমার তিনটি ছাগল মারা গেছে। এসবের ক্ষতি পুরণ কে দিবে? কার কাছে যাবো ক্ষতি চাইতে?


আঙ্গুরি বেগমের মতো এরকম আরো অনেকের ক্ষতি হয়েছে। এই তীব্র দাপদহের কারণে শারীরিক অসুস্থতা রোগবালাই বেড়ে গেছে, যার ফলে অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হচ্ছে ঔষধ কিনতে। আলবিকুস হে¤্রম (৪৫) বলেন, ‘শরীরে ঝিমুনি মাথা ব্যাথা, আবার গায়ে ফুসকরনি চুলকানি, বাচ্চাদের সর্দি জ¦র বেড়েছে। এমনিতেই কাজের অভাবে টাকা নেই, আবার ঔষধ কেনার দায়। আবার অন্যদিকে ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ।’ সবমিলে তিনি সমস্যার মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন।


বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা পর্যবেক্ষণে জানা যায়, এই তীব্র তাপদহের কারণে শ্রমজীবী মানুষের কাজ না থাকার কারণে তাঁদের ধার দেনা দায় বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ঘরের যে একমাত্র নিদান কালের সঙ্গী গবাদি পশু পাখি সেগুলোর রোগ বালাই বেড়ে গেছে। মানুষসহ গবাদি পশু পাখির রোগ চিকিৎসা ব্যায় বেড়েছে । নানাভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীই ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলো দিনে দিনে বরেন্দ্র অঞ্চলে আরো স্পষ্ট হচ্ছে। গোটা আষাঢ় মাসেও বৃষ্টির দেখা মেলেনি। শ্রাবণ এসেছে, একটু একটু করে বৃষ্টি হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, চলতি আষাঢ় মাসেই গতবছরের তুলনায় বৃষ্টি কমেছে ৩১৪ দশমিক ৯৮ মিলি মিটার। যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আরো কম। বৃষ্টিপাত না থাকার কারণে এই ভরা বর্ষা মৌসুমেই ৩৬ থেকে ৪১ ডিগ্রী সেলসিয়াসে তাপমাত্রা উঠানাম করেছে। সেটিও অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি।
তানোর মোহর গ্রামের যুব কুষক ও মোহর স্বপ্ন আশার আলো যুব সংগঠনের সদস্য মো. আলমগীর হোসেন (২৫) বলেন, ‘আবহাওয়া জলবায়ুর মারাত্মক পরিবর্তনে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আমরা দায়ি নই, কিন্তু কেন এই ক্ষতির শিকার আমাদের নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের ক্ষতিগুলো পুষিয়ে দেবে কে?

happy wheels 2

Comments