এহনও আমার মতো লোক পাইবেন না বরো
মানিকগঞ্জ থেকে শুকুফে ইসলাম
প্রবীণ বয়সটাই হলো অনেকটা দীর্ঘশ্বাসের মতো কেউ খোঁজ নেবার থাকেনা, কেউ যত্ন নেবার থাকেনা আবার থাকে না কেউ পাশে থেকে সাহস দেবার! তবুও জীবন থেমে থাকে না-জীবন এগিয়ে চলে আপন গতিতে। কথা হচ্ছিল মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা গ্রামে অবস্থিত পাল পাড়ার গৌড় পাল (৯০) এর সঙ্গে। তিনি কথা প্রসঙ্গেই একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আক্ষেপ করে বললেন, “৪০ বছর বয়সীরে বুইরা (বয়স্ক) বানায়ে ভাতা দিতেছে, আর আমি বুইরা পাই না। মেম্বর-চেয়ারম্যানরে কইলেও কাজ হয় না, আমরা অবহেলিত।” তবুও তিনি থেমে থাকেন না, ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে তার পৌত্রিক পেশা মাটির তৈজসপত্র তৈরি করে মানুষের মাঝে বিক্রি করার জন্য। বয়সের ভাড়ে তিনি ন্যূজ নন বরং আত্ম-প্রত্যয়ী আর দৃঢ়।
প্রতিবছর দু’বার (মনসা ও লক্ষ্মী) পূজা উপলক্ষে মানিকগঞ্জ জেলা শহরের লক্ষ্মী মন্ডপ মন্দির প্রাঙ্গনে ঘট, সরা (লক্ষ্মী সরা) বিক্রয় করতে আসেন গৌড় পাল। প্রায় ২০ বছর বয়স থেকে তিনি নিয়মিত বেচা-বিক্রি করতে আসেন এখানে। কতদিন ধরে এই পেশার সাথে যুক্ত জানতে চাইলে বলেন, “পৈত্তিক সূত্রে এটাই আমাদের আদি পেশা।” তাঁর বাবা মাটির কাজ করতেন কিন্তু ১৯৫০ সালের আকালে বাবা মারা যাওয়ার পর, পাঁচ মেয়ে ও দু’ ছেলে নিয়ে মা পরিবারের হাল ধরেন। বয়োঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর তিনিও পরবর্তীতে এই পেশায় যুক্ত হন। দুই ছেলে আর এক মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে, ছেলে বউ, তাঁর বউ মাটির তৈজসপত্র তৈরির পেশায় যুক্ত থাকলেও, ছোট ছেলে স্বর্ণের দোকানে কাজ করে। তবে ছোট ছেলে তার আদি পেশায় যুক্ত না থাকলেও তার কোন আক্ষেপ নেই।
মানুষ তো আর আগের মতো মাটির জিনিস ব্যবহার করে না তারপরও কেন এই পেশার সাথে যুক্ত আছেন প্রশ্ন করলে বলেন, “এটা আমার বাপ-পূর্ব পুরুষের পেশা। চাইলেই তো ছাড়া যায় না।” আগের দিন ও পেশা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আগের সুমই (সময়ই) ভালা আছল(ছিলাম)..এহন সিলভরের জিনিসে ভইরে গিয়ে আস্তে আস্তে মাটির কাজ কমে গেছে। ওহনকার মানুষ মাটির হাড়িতে ভাত রান্দে না, সিলভর, প্লাস্টিকের বাসনে রান্দে..এখন খাইতেছি বিশ! অসুখ-বিসুখ তাই বাড়তেছে”।
তিনি বেশ গর্ব করেই বলেন, “এহনও মাটির হাড়িত বাত রান্দি। এহনও আমন ধানের ভাত খাই। এহনও আমার মতো লোক পাইবেন না বরো”।
কথপোকথনের মাঝে আস্তে আস্তে ভীড় বাড়তে থাকে আর তিনি ব্যস্ত হতে থাকেন। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এখন তাঁর কি প্রত্যাশা জানতে চাইলে তিনি বারসিক নিউজকে জানান, সরকারের পক্ষ থেকে বয়স্কদের জন্য বয়স্ক ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা আছে। গ্রামের অনেকেই সুবিধাটি পেলেও, তিনি তা পান না। এভাবে তিনি যেন আর বঞ্চিত না হন।
শুধু গৌড় পাল নন, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রবীণ ব্যক্তিরা আজ অসহায়, নিগৃহীত, প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। আমাদের আজকের সমাজ বিনির্মাণে একসময় যাদের অক্লান্ত কর্মযজ্ঞ প্রধান পাথেয় ছিল, সেই তাদের অবদান এখন অস্বীকৃত। পদে পদে লাঞ্ছনার শিকার তাঁরা। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন এক সময় হয়তো আমাদেরও হতে হবে। তাই প্রবীণ ও সমাজের বয়োজ্যোষ্ঠদের যোগ্য সম্মান ও প্রাপ্য দেওয়াটা আমাদের একটি প্রধান কাজ। যারা এই সমাজকে আজকের দিন পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে এসেছেন আমরা আসুন আজ তাদের পাশে দাঁড়াই।