ভাগ্য উন্নয়নের প্রচেষ্টায় রাবেয়া মল্লিক
সাতক্ষীরা থেকে মহিরঞ্জন মন্ডল
নারীরা ও পুরুষের পাশাপাশি নিজেদের সংগ্রাম সাহস আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছেন দুর্বার গতিতে। সময়ের সাথে সাথে নারীরা নিজের গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি পরিবারের অর্থনৈতিক কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে উন্নয়নের সহযাত্রী হয়ে ভূমিকা পালন রেখে চলেছেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ঝাপা গ্রামের রাবেয়া মল্লিক (৩০) তেমনই একজন উদ্যোগী নারী। স্বামী, শশুর শাশুড়ী ও দুই সন্তান সহ ৬ সদস্যের সংসার তার। স্বামী হযরত মল্লিক (৪০) পেশায় দিনমজুর। একমাত্র মেয়ে (১১) ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ালেখা করে ও ৬ বছরের আরো একটি ছেলে সন্তান রয়েছে তাঁর। নিজেদের ১০ শতক বসতভিটায় মৌসুমভিত্তিক নানা জাতের কৃষি ফসল উৎপাদন করে সংসারের আংশিক চাহিদা পূরণ হলে বাকি অংশ নির্ভর করতে হয় পুরোপুরি বাজারের উপর। অভাবের মধ্য থেকে নিজেই খুঁজতে থাকে নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক মুক্তির পথ। যুক্ত হয় বারসিক’র সাথে।
২০২১ সালে অক্টোবর মাসে নেটজ পার্টনারশিপ ফর ডিভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় বারসিকের বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ঝাঁপা গ্রামে “জবা” সিএসও দলে যুক্ত হয় রাবেয়া। যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক দলীয় আলোচনায় সভায় অংশগ্রহণ করেন। কিছুদিন পরে বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে তার পারিবারিক ও ব্যবসায়িক উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে উৎপাদনশীল সম্পদ হিসেবে ছিট কাপড় ও সেলাই মেশিন উপকরণ সহযোগিতা করা হয়। পরিবেশ প্রকল্প থেকে তাকে একই সাথে একটি কদবেল ও সবেদার চারা, কিছু বর্ষাকালীন বীজ ও দু’টি হাঁস সহযোগিতা পান। এরপর বারসিক এর নিয়মিত আলোচনা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহযোগিতায় তিনি নিজেকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করার সুযোগ পান।
সেলাই মেশিনের কাজ শেখার তার প্রবল ইচ্ছা, কিন্তু হাতের কাছে তেমন কোন প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগ না থাকয় তিনি দর্জির কাজের অডার তেমন বেশি পান না। ফলে ছিটকাপড় সহযোগিতা পাওয়ার পরে সেগুলো বিক্রির মাধ্যমে নিজের আয়ের চাকা কিছুটা সচল হয়। গ্রামের মানুষ তার কাছে আসলেই পছন্দের ছিটকাপড় পেয়ে যায়। এভাবেই দৈনিক ছিট বিক্রির মাধ্যমে তার আয় বাড়তে থাকে। কিন্তু এই আয় তার পরিবারের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে তিনি সেলাই মেশিনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য খোঁজ নিতে থাকেন যে কোথা থেকে নেওয়া যায়। একপর্যায়ে তিনি জানতে পারেন যে বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকল্পের অংশগ্রহণকারী সদস্যদের আগ্রহ ও বর্তমান বাজার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। তিনি তার আগ্রহের কথা সংস্থার জানান এবং প্রশিক্ষণার্থী হিসাবে যুক্ত হন এবং তিন মাস স্থানীয় পর্যায়ে সুন্দর ভাবে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ শেষ করেন।
প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর থেকে গ্রামের মানুষ তার কাছে কাজের অর্ডার দিতে থাকে। নিজের কাছে একদিকে সেলাই মেশিনের জন্য মানুষ পোশাক তৈরি করতে আসে অপরদিকে গ্রামের মানুষ তার কাছে আসলেই পছন্দের ছিটকাপড় পেয়ে যায়। এভাবেই দুটি বিষয়ের বদৌলতে তাঁর দৈনিক আয় বেড়ে যায়। তিনি তার আয়ের টাকা সংসার চালানোর পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করতে চান।রাবেয়া মল্লিক এ বিষয়ে বলেন, “স্বামীর একার আয়ে বর্তমান সময়ে টিকে থাক কষ্টকর, তাই সংসারের আয় বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের কাজ করি বিশেষ করে সেলাই মেশিন ও ছিটকাপড় বিক্রি করে আয় করছি। আমি বারসিক থেকে ছিটকাপড় ও সেলাই মেশিন সহযোগিতা নিয়ে আমার ব্যবসাটাকে ভালোভাবে চালু করতে পারছি। লাভের টাকা দিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে নিয়মিত সঞ্চয় জমা করি।” সপ্তাহ বা ১৫ দিন পর পর মালমাল বিক্রির টাকা একত্রিত করে পুনরায় ছিটকাপড় কিনে এনে ব্যবসাকে সমৃদ্ধি করে চলেছেন। মাসে সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার থেকে টাকা আয় হয় তাঁর।
রাবেয়া মল্লিকের মত এমনিভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা নিজেদের আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও আত্মপ্রত্যয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বপ্ন জয়ের আশায় কঠোর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।