খনার বচন ও আমাদের কৃষি
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ, বাংলাদেশ। প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর এ দেশে ঋতু পরিবর্তন হয়। বর্তমান সময়ে শীত, গ্রীষ্ম আর বর্ষা ছাড়া বাকি তিনটি ঋতুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই এখন কষ্টকর। বাংলা বছরের প্রতিটি মাস, প্রতিটি ঋতু এমনকি প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে জ্ঞানী নারী খনা’র কিছু উক্তি বা বচন আছে। তাঁর এ উক্তি শুধু কৃষি নয়, বাঙালির সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকা, পার্বণ প্রভৃতি বিষয়ের সাথে ঘনিষ্টভাবে সংশ্লিষ্ট। এখনো আমাদের দেশের কৃষকরা হালচাষ, শস্য রোপণ, নতুন ঘর তৈরি করা ও ফসল কাটার সময় খনার বচনকে অগ্রাধিকার দিয়ে সকল কাজ শুরু করেন। তবে কৃষি প্রধান দেশ বলে আমাদের দেশে কৃষি সম্পর্কিত খনার বচনকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি। যেমন,
আশ্বিনের ঊনিশ, কার্তিকের ঊনিশ,
বাদ দিয়ে মটর কলাই বুনিস।।
আশ্বিন মাসের শেষের ঊনিশ দিন এবং কার্তিক মাসের প্রথম ঊনিশ দিন পর্যন্ত তেলবীজ বা ডাল জাতীয় শস্য আবাদের উপযুক্ত সময়। এই সময়ে যারা জমিতে সরিষা, খেসারি, মাসকলাই ইত্যাদি বাইন করেন তাদের ফসল ভালো হয়। তাছাড়া চলতি বছরে অন্যান্য বছরের তুলনায় শীতের প্রকোপ তেমন ছিল না। কুয়াশা বা হাঁড় কাঁপানো শীতও পরেনি। যে কারণে শীতের শুরুতে যে ফসলগুলো চাষ করা হয়েছেল সেগুলোর বেশ ভালো ফলন হয়েছে। যেমন সরিষা, মাসকলাই, শিম, মূলা, বেগুন ইত্যাদি। নেত্রকোনার বিভিন্ন গ্রাম (সুলতানগাতী, কান্দাপাড়া, ঘিডুয়ারী, কোনাপাড়া, কিসমতআড়া, স্বরমশিয়া) ঘুরে দেখা গেছে গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় প্রতিটি গ্রামেই সরিষার চাষ হয়েছে এবং ফলনও বেশ ভালো হয়েছে।
রামেশ্বরপুর গ্রামের কৃষক সায়েদ আহাম্মদ খান বাচ্চু বলেন,“এই বছর বৃষ্টি বেশি হওয়ার কারণে শীত কম পড়ছে। যে কারণে সইষ্যার (সরিষা) বাম্পার ফলন হইছে। কুয়াশা পড়ছেনা দেইখ্যা মাসকালাই, সইষ্যাার দানা পুষ্ট হইতে পারছে। কুয়াশা বেশি পড়লে গাছের পাতা মইরা যায়। আবার ফলও সঠিক সময়ে বাইর অইতে পারেনা।”।
কোনাপাড়া গ্রামের কৃষক মো. আবুল মিয়া বলেন, “আমরা সাধারণত আশ্বিন/কার্ত্তিক মাসে সইষ্যা বাইন করি। এইবারও তাই করছি। কিন্তু এই বছর যহন সইষ্যা বাইর অইছে (কার্ত্তিক/অগ্রহায়ণ মাস) তহন কোনো বৃষ্টি নাই। আবার কুয়াশাও নাই। আমি ৫ কাঠা (৫০ শতাংশ) জমিনো সইষ্যা বাইন করছি। একটা গাছও বাদ গেছেনা, প্রত্যেকটার মইধ্যে ছই বাইর অইছে। উডাইলে বোঝা যাইবো কয় মণ অইছে”। কিসমতআড়া গ্রামের প্রায় ২০জন কৃষক নদীর চরে সরিষা ও মাসকালাই চাষ করেছেন। তাদেরও মন্তব্য একই রকম।
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় কোনো কোনো ফসলের জন্য বৃষ্টি যেমন অতি প্রয়োজনীয় তেমনি কোনো ফসলে এর বিপরীত। খনার বচনে বাংলা বছরের বিভিন্ন মাসে বৃষ্টির উপর নির্ভর করে ফসল চাষ ও উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। যেমন,
কার্তিকের জল ঊনো, (কম)
ধান জন্মে দুনো (বেশি)।।
অর্থাৎ কার্তিক মাসে যত অল্প জল হবে, ধান গাছে তত বেশি ধান ফলবে। আবার আরেকটি বচনে বলা আছে,
যদি বর্ষে আগনে, (অগ্রহায়ণে)
রাজা যান মাগনে (ভিক্ষা করতে)।।
অর্থাৎ যদি কোনো কারণে অগ্রহায়ণ মাসে বেশি বৃষ্টি হয় তাহলে ফসল ভালো হয় না। কোনো কৃষক ঘরে ফসল তুলতে পারেনা। কৃষককে ভিক্ষা করতে হয়। স্থানীয় কৃষকদের মতে, এ বছর কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে বৃষ্টিপাত হয়নি বলে ধান ফসলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। তাঁরা ফসল ঘরে তোলার পাশাপাশি ধান বিক্রি করে ভালো দামও পেয়েছেন।
প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কৃষি শুধু ধান বা সবজি চাষেই সীমাবদ্ধ নয়। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মৌসুমী ফল। এ বছর কুয়াশা বা বৃষ্টি না থাকায় সবজির ফলন ভালো হলেও মৌসুমি ফলের উৎপাদন সুবিধাজনক নয়। এ বিষয়ে খনার বচনে বলা আছে,
অঘ্রাণে যদি বৃষ্টি না পড়ে,
গাছে কাঁঠাল নাহি ধরে।।
এ বছর অঘ্রাণ বা পৌষ মাসে কোনো বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে কাঁঠাল গাছের মজি (স্থানীয় ভাষা) বা কচি কাঁঠালগুলো পঁচে যাচ্ছে। আম ও লিচু গাছেও কোনো মুকুল আসেনি।
যদি বর্ষে পৌষে,
কড়ি হবে তুষে।।
খনার এ কথার অর্থ হলো পৌষ মাসে বৃষ্টি হলে তুঁষ (ধানের খোসা) বিক্রি করেও টাকা পাওয়া যায়। অর্থাৎ এ সময়ের বৃষ্টিতে ফসল ভালো হয়। আমাদের দেশে ফসলের সঠিক উৎপাদন হলে তা বিক্রি করেই কৃষক লাভবান হতে পারেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে খনার বচনের সাথে পরিবেশ বা আবহাওয়ার কোনরূপ মিল না থাকায় বৃষ্টিপাত যেমন হয়নি, তেমনি কৃষকের রোপণকৃত রবিশস্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় শীতকালে আমাদের জমির মাটি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, যা ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ১৬ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত রবি মৌসুম। এই সময়ে কৃষকরা বিভিন্ন প্রকার সবজি, ডালবীজ, তেলবীজ ইত্যাদি ফসল চাষ করেন। যে ফসল চাষের জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন হয় সে সময় বৃষ্টি না হলে ফসলের উৎপাদন আশানুরূপ হয় না। আবার বৃষ্টি বেশি হলে ফসল নষ্ট হয়। পরিমিত বৃষ্টিপাতে ফসলের উৎপাদন ভালো হলে কৃষকের গোলা ভরে উঠে। প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী ফসল চাষ করলে একদিকে যেমন উৎপাদন ভালো হয় অন্যদিকে তেমনি ফসলের স্বাদ বা গুণাগুণ ঠিক থাকে। আবার বীজেরও কোনো সমস্যা হয় না। বিদূষি নারী খনা নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষি সম্পর্কিত যেসব মতামত ব্যক্ত করে গেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তার বিপরীত প্রভাব পড়ছে আমাদের কৃষিতে। কোনো বছর বৃষ্টি বেশি আবার কোনো বছর কম, শীত নেই, কুয়াশা বেশি জলবায়ু পরিবর্তনের এই রূপ প্রতিনিয়ত ব্যাহত করছে আমাদের কৃষিকে।