আত্মপ্রত্যয়ী শিক্ষার্থী ফতেমা পারভীন
শ্যামনগর সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
ফাতেমা একজন গরিব, মেধাবী ও আগ্রহী স্কুল শিক্ষার্থী। বনজীবী পরিবারের সন্তান সে। পিতার অর্থনৈতিক অবস্থা সবল না হওয়ায় একসময় তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তাঁর পিতা তাকে পাঠ্যপুস্তক কিনতে না পারায় সে খুবই কষ্ট পেয়েছিলো। পাঠ্যপুস্তক না পাওয়ায় তাঁর পড়ালেখা বন্ধ হয়। পড়ালেখা করতে পারবে না সেই কষ্ট থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য একসময় সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তবে ওই যাত্রায় বেঁচে যায় সে। বিষপানের সাথে সাথে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোয় বেঁচে যায় ফতেমা। হাসপাতালে সংবাদিক, উন্নয়নকর্মীসহ নানান মানুষের সাথে তার পরিচয় হয়। তার পড়ালেখার তীব্র ইচ্ছাকে সাধুবাদ জানিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ায় বারসিকসহ অন্যান্য তরুণরা। বিভিন্ন মানুষের এই সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা আত্মহত্যার চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া ফতেমা প্রতিজ্ঞা করে আর কোনদিনও এ পথ বেছে নেবে না। বরং হতাশাকে জয় করে আবারও নতুন উদ্যমে পড়ালেখা শুরু করে সে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতকার্য হয়। কেন ফতেমা পারভীন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলো?
ফতেমা বেগমরা এক ভাই ও ৫ বোন। শিক্ষার খরচ চালাতে না পেরে বড় তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ফতেমা তার পরিবারের ৪র্থ মেয়ে। ছোটবেলা থেকে বরাবরই লেখাপড়ায় ভালো। সে সপ্তম শ্রেণী প্রর্যন্ত লেখাপড়া করেছে তাদের পাশের বাড়ির একটি মেয়ের বই পড়ে! উচ্চ বিদ্যায়য়ে পড়ার পর থেকে ফতেমার বাবা তাকে বই কিনে দিতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে ফতেমা তার একজন বান্ধবীর বই পড়ে ক্লাসে যেতো এমনকি পরীক্ষা দিতো। অনেকসময় তার ক্লাসের অন্যান্য সহপাঠীদের বইও পড়তো সে। এজন্য অবশ্য তাকে বিভিন্ন সময়ে নানান কথা শুনতে হয়। তারপর সে দমে যায়নি। তার সহপাঠীরা তাকে প্রায়ই বলতো “যখন বাইরের পরীক্ষা দিতে যেতে হবে তখন কি করবি, এর থেকে ভালো পড়তে হবে না।” এ কথা শুনে ফতেমার খুব মন খারাপ হতো। মাঝে মাঝে তার বাড়ি থেকেও বলতো ‘এত কষ্ট করে পড়ালেখা করার দরকার নেই’।
পঞ্চম শ্রেণীতে ফতেমা এ+ পায়। তবে ৮ম শ্রেণীতে উঠার পর দেখা দিল নতুন সমস্যা। পাশে যে বান্ধবীর বাড়ি থেকে ফতেমা এতদিন পড়তো সেই বান্ধবীর বাবা বদলি হয়ে শ্যামনগরে চলে যান। এদিকে ফতেমা এতদিন পর্যন্তও বই কিনতে পারেনি। ওই বান্ধবীর বই পড়েই ক্লাস ও পরীক্ষা দিয়ে আসতো। ফতেমার চিন্তা হয় যে, স্কুলে পড়া না পারলে স্যাররা রাগ করবেন! উপায় না দেখে সে নিজেই বই জোগাড় করার চেষ্টা করলো। এভাবেই সে জানতে পারে, গ্রামের একটি মেয়ের বিয়ে হওয়ায় পড়ালেখা বাদ দিয়েছে। ফতেমা ভাবে, ওই মেয়েটির বই কিনতে পারলে খুব ভালো হতো। ফতেমা জানতে পারে, অর্ধেক হলেও বইয়ের দাম দাঁড়ায় ৭০০ টাকা। বাড়িতে ফিরে এসে সে বই কেনার বিষয়টি তার মাকে জানায়। তার মা সরাসরি বলেন, “এতো টাকা দিয়ে বই কিনে পড়ালেখা করা লাগবে না।” মায়ের কথা শুনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ফতেমা। ফতেমা বলে, “বিলে বসে একা একা কান্নাকাটি করতাম। একসময় মনে হলো এভাবে বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া অনেক ভালো। এই ভেবে বিষপান করে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করি। বিষপান করা অবস্থায় আমাকে শ্যামনগর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।” ফতেমা আরও বলে, “হাসপাতালে সাংবাদিকদের সাথে পরিচয় হয়। তারা আমার সব কথা শুনে বারসিক’র কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে যায়। তাদের সাথে কিছু ছাত্ররাও আমার পাশে যায় এবং তারা আমার সাহস যোগায়। তারা আমার পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়ে আমার পাশে দাঁড়ায়। পড়ালেখার জন্য আমার হাতে ৮ম শ্রেণীর এক সেট বই তুলে দেয়।” নতুন বই পেয়ে ফতেমা খুব খুশি। হাসপাতাল থেকে ফিরে সে আবার পড়ালেখা শুরু করে।
ইউনিয়নের জয়াখালী গ্রামের বনজীবী আব্দুল মজিদের কন্যা ফতেমা পারভীন (১৭)। শত কষ্ট ও প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যায়। তার পাশে থেকে বিগত দু’বছর সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম ও বারসিক কর্মকর্তা বিভিন্ন সাহস, আশ্বাস ও সহায়তা দেন। এ প্রসঙ্গে ফতেমা পারভীন বলেন, “একজন গরিব শিক্ষার্থী হিসেবে আমি যখন হতাশাগ্রস্ত ছিলাম, এমনকি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলাম তখন বারসিক সেই সময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। পড়ালেখা নিয়ে আমার যে কষ্টটা ছিল সেটা দূর করে দিয়েছে। আমার সাথে আরো অনেক শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটেছে তাদের মাধ্যমে। যারা আমাকে মানসিকভাবে সাহস যোগাতে সাহায্য করেছে। আমার বই কেনা, পরীক্ষার ফি দেয়া, প্রাইভেট স্যারের বেতন, ফরিক্ষার ফি, পরীক্ষার ফরম ফিলাপ কোন কিছু নিয়ে আমাকে আর চিন্তা করতে হয় না।”
২০১৭ সালে এসএসসি পরিক্ষায় ফয়সেলাবাদ মুস্তাফাবিয়া আলিম মাদ্রাসা থেকে ফতেমা অ- পায়। তার প্রাপ্ত পয়েন্ট ৩.৭৫। এ ফলাফলে ফতেমা খুশি। সে মনে করে পিতামাতা ছাড়াও এই পৃথিবী আরও মানুষ আছে যারা পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে আনন্দ পায়। ফতেমার স্বপ্ন হচ্ছে ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তার মতো দরিদ্র শির্ক্ষার্থীকে সহযোগিতা করতে চায় সে।