মসলা চাষে রেশনা বেগমের সাফল্য

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের শতকরা প্রায় ৭৮জন লোকই কৃষির উপর নির্ভরশীল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, কৃষির সূচনা হয়েছিল নারীর হাত ধরে। নারীরাই প্রথম বীজ থেকে ফসল উৎপাদন শুরু করেন। আজও গ্রামীণ নারীরাই ধরে রেখেছেন আমাদের কৃষি, কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য ও বিলুপ্ত গ্রামীণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এক সময় নেত্রকোণা অঞ্চলে বৈচিত্র্যময় ফসলের চাষ হতো, ফসলের গন্ধে সারা এলাকা মৌ মৌ করতো। কিন্তু বর্তমানে কৃষকরা একক ফসল (ধান) চাষের উপর ঝুঁকে পড়ায় দিনদিন কমে যাচ্ছে এ অঞ্চলের শস্য বৈচিত্র্যতা। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী সবকিছুর জন্য (বীজ, কৃষি উপকরণ, বাজার ইত্যাদি) এখন বাজারের উপর নির্ভরশীল। তারা নিজেরা প্রয়োজনীয় শস্য বীজ না রেখে বাজার/কোম্পানির বীজের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। ফলে  বাজারের বীজে সমস্যা হলে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছেন।

232
অন্যদিকে আমাদের দেশে শস্য বীমা ব্যবস্থা না থাকায় কোন মৌসুমে ফসলের কোন ক্ষতি হলে সরকারিভাবে বা সংশ্লিষ্ট বীজ কোম্পানি থেকে কৃষকরা কোন ধরণের ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। যেমন চলতি বোরো মৌসুমে নেত্রকোণার হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যা এবং দেশের ভিভিন্ন অঞ্চলে ধানের ব্লাস্ট রোগে ধান ফসলের এবং পাট ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলেও কৃষকরা তার জন্য কোন ক্ষতিপূরণ পাননি। কিন্তু গ্রামে এখনও কিছুসংখ্যক উদ্যোগী নারী (কৃষাণী) আছেন, যারা নিজ উদ্যোগে ও প্রয়োজনে ফসলের বৈচিত্র্যতা রক্ষার চেষ্টা করে চলেছেন, স্বল্প পরিসরে হলেও সংরক্ষণ করছেন তাদের প্রয়োজনীয় শস্য বীজ, সহযোগিতা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন অন্যান্য কৃষক-কৃষাণীদের।

এমনই একজন কৃষাণী নেত্রকোনা সদর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের নরেন্দ্রনগর গ্রামের রেশনা বেগম (৪০+)। তিনি মসলা জাতীয় ফসলের চাষ করে এবং বীজ সংরক্ষণ করে মসলার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন। স্বামী ও তিন সন্তানসহ রেশনা বেগমের (দুই মেয়ে ও এক ছেলে) মোট পাঁচ জনের সংসার। বাড়িভিটাসহ তার মোট জমির পরিমাণ ২০ শতাংশ। নিজের আবাদযোগ্য জমি নাই, তাই তিনি অন্যের জমি বর্গা ও লিজ নিয়ে সবজি চাষের পাশাপাশি সব ধরনের মসলা চাষ করেন। তার চাষকৃত মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে আদা, হলুদ, মরিচ, পেয়াজ, রসুন, ধনিয়া, তেজপাতা,  গুড়ামুড়ি ইত্যদি উল্লেখযোগ্য। এই বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলে রেশমা বেগম বলেন, ‘‘মসলা একটি লাভজনক ফসল, বাজারে মসলার চাহিদাও বেশি এবং প্রায় সারাবছর আবাদ করা যায়, তাই আমি দশ বছর ধরে মসলার চাষ করছি।’’

323
একেকটি মসলা ফসল তিনি একেক পদ্ধতিতে চাষ করেন। রেশনা বেগম হলুদ বীজ জমিতে রোপণ করেন চৈত্র মাসে এবং আদা বীজ রোপণ করেন বৈশাখ মাসে। তবে চৈত্র মাসে বৃষ্টি হলে আদা বীজ রোপণ করা যায়। আদা ছায়াযুক্ত জমিতে ভালো হয়। রেশনা বেগম বলেন, “চৈত্র-বৈশাখ মাসে আদা ও হলুদ গাছ বড় হইয়া মইরা মাটিতে লেটাইয়া গেলে (শুকনা খরেরমত) আদা ও হলুদ বীজের লাইগা রাখতে অয়। ক্ষেত থেইক্যা আদা ও হলুদ তুইলা ভালো কইরা মাটি ঝাহি দিয়া পরিস্কার কইরা রইদে ১/২ দিন শুকাইয়া মাঁচার নিচে অন্ধকার জায়গায় রাহন লাগে। এতে আদা ও হলুদ বীজ পুষ্ট ও সুন্দর থাকে। এক/দু’দিন শুকানোর পর আদা সংরক্ষণ করলে ভালো থাকে।”

রেশনা বেগম জানান, রসুন গাছ শুকিয়ে গেলে রসুন ফসল সংগ্রহ করা হয়। ক্ষেত থেকে শুকনা গাছসহ রসুন উঠিয়ে বাঁশের আড়ায় বেঁধে ঝুলিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। তার আগে শুকিয়ে যাওয়া গাছসহ রসুন ৩/৪দিন শুকিয়ে তারপর ঘরে আড়ার সাথে ঝুলিয়ে পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত সংরক্ষণ (এক বছর) করা যায়। নিজের চাষকৃত প্রত্যেক জাতের মসলার বীজ তিনি সংরক্ষণ করেন। রেশনা আক্তারের মতে, যে কোন বীজ সংরক্ষণের জন্য তা ভালোভাবে রৌদ্রে শুকানো জরুরি। মসলা বীজগুলো (আদা, হলুদ, পেঁয়াজ ও রসুন ছাড়া) কাঁচের বোতলে বা বয়ামে সংগ্রহ করলে বীজের মান খুব ভালো থাকে। রেশনা বগেম বলেন, “আমার কোন বীজ কিনতে অয় না, হারা বছরই মসলা আবাদ করি আর নিজের খাওন ও আত্মীয়রারে দেওনের পর বাহী মসলা বাজারত বিরহি করি সংসারর কামত লাগাত পারইন। আমার ক্ষেতত এক মুষ্টি সার দিওন লাগেনা।” তিনি আরও বলেন, “আমার ৩ ডা গরু আছে, আমি গোবর দিয়ে জৈব সার বানাইয়া জমিত ছিটাই। আমি নিজেই কোদাল দিয়া ক্ষেত কোপাইয়া মসলা বুনি। মসলা চাষ করাত তেমন কোন খরচ অয়না, খাটনিও কম এবং লাভ বেশি”। রেশনা বেগম চলতি বছরে গ্রামের ৫০ জন কৃষক-কৃষাণীকে ১০টি জাতের মসলা ও শস্য বীজ বিতরণ করেছেন।

মসলার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ধরণের সবজি যেমন-মিষ্টিকুমড়া, শসা, পুইশাক, সীম, বেগুন, আলু ইত্যাদি চাষ, বীজ সংরক্ষণ ও গ্রামের অন্যদের সাথে বিনিময় করে থাকেন। রেশনা বেগম জানান, মসলা চাষে তেমন কোন খরচ হয় না শুধুমাত্র বীজ ক্রয় ও জমি চাষ ছাড়া। বীজ রোপণ করার পর কোন রকম যত্ন করলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়, সার ও কীটনাশকেরও তেমন প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অন্যান্য ফসলের চেয়ে মসলা চাষে অনেক লাভ।

আমাদের দেশের বিশেষভাবে নেত্রকোণা অঞ্চলের কৃষকরা একক ফসল চাষাবাদের ফলে মসলা জাতীয় ফসলের জন্য দেশের অন্যান্য অঞ্চল এবং ভিন্ন দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে বছরের বিভিন্ন সময়ে যেমন রোজা বা ঈদের মতো বিভিন্ন উৎসবে চড়া মূল্যে এসব মসলা কিনতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে এসব মসলার এতই উচ্চ মূল্য হয় যে, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। তাই নেত্রকোণা অঞ্চলসহ দেশের সকল অঞ্চলের কৃষকদেরকে একক ফসল চাষাবাদ না করে মসলাসহ বৈচিত্র্যময় ফসল চাষে এগিয়ে আসতে হবে, তবেই এসব ফসল যেমন সকলের জন্য সহজলভ্য হবে, তেমনি পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য হবে সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত। বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ যেমন প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফসলের ক্ষতির হাত থেকে কৃষকদেরকে রক্ষা করবে, তেমনি বৈচিত্র্যময় প্রাণেরও সমাবেশ ঘটাবে, যা ফসলের পরাগায়ন বৃদ্ধি করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করবে এবং খাদ্য বৈচিত্র্যতা নিশ্চিত হবে।

happy wheels 2

Comments