ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকনা, বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তুলে মহাদেশ….
সিলভানুস লামিন
এক
ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তমের সৃষ্টি। মানুষসহ প্রতিটি প্রাণ ও উদ্ভিদকনার দেহ ব্যবচ্ছেদ করলে অসংখ্য ক্ষুদ্র অণু ও পরমাণুর সমষ্টি দেখা যাবে। পৃথিবীতে যত ধরনের বড় ভালো কাজ, উন্নয়ন এবং অগ্রগতি শুরু হয় ছোট্ট ছোট্ট একটি মহৎ বা ভালো কাজ থেকে। তাই কোন এক মনীষী বলেছেন, ‘ছোট্ট কাজে যে আন্তরিক থাকে, সে বড় কাজেও আন্তরিক থাকবে।’ অর্থ্যাৎ ক্ষুদ্রকে তাচ্ছিল্য করা বা আমলে না নেওয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। একটি অট্ট্রালিকা অসংখ্য ইট, সিমেন্ট, বালু দিয়ে গড়া। এটি নির্মাণেও ছোট্ট ও বড়, বুদ্ধিমান ও কম বুদ্ধিমান, দুর্বল ও শক্তিশালী মানুষগুলোর সম্মিলিত শক্তি ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে যারা এই অট্টালিকা নির্মাণে কাজ করেন তারা কেউ হয়তো আকারে বড়, কেউ ছোট, কেউবা হয়তো বেশি শক্তিশালী, কেউবা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হতে পারে। প্রকৌশলীদের মধ্যেও কেউ বেশি দক্ষ, বুদ্ধিমান, কেউবা তুলনামূলকভাবে কম দক্ষ ও বুদ্ধিমান হতে পারে। তবে তাদের সমন্বিত শ্রমের ফলের মাধ্যমে একটি অট্টালিকা, একটি ব্রিজ এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ হয়। একইভাবে যেকোন কিছু সৃষ্টি বা উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজন হয় ক্ষুদ্র থেকে শুরু করার। একটি গাড়ি, একটি জাহাজ, একটি উড়োজাহাজ, একটি টিভি বা কমিম্পউটার উদ্ভাবনের জন্যও প্রয়োজন হয় ক্ষুদ্র থেকে শুরু করা। রাতারাতি কোন বড় আবিষ্কার বা উদ্ভাবনই বড় থেকে শুরু হয় না। একজন মানুষের পৃথিবীতে আসার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। ভ্রুণ থেকে শুরু হয় একজন মানুষের পৃথিবীতে আগমন করার প্রক্রিয়া। এই ভ্রুণটি আস্তে আস্তে মানবদেহে রূপান্তরিত হয়। একই কথা বলা যায়, মানুষের সার্বিক উন্নয়ন সংঘটনের বেলায়। ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর পরিসরে উন্নয়ন সাধিত হয়। ক্ষুদ্রকে বাদ দিয়ে সামগ্রিক ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন হতে পারে না।
নিজ দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য সরকারের পাশাপাশি অনেক উন্নয়ন সংগঠন কাজ করে। তবে দেখা যায়, সরকার বা উন্নয়ন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান লক্ষ্যই থাকে বৃহত্তর কোন উন্নয়ন সাধন করা। সেক্ষেত্রে তারা সবচে’ বড় সমস্যাটি সমাধান করার উদ্যোগ নেয়। এলাকার ছোট্ট ছোট্ট সমস্যাগুলো অগোচরে থেকে যায় বা আড়ালে পড়ে যায়। দেখা যায়, বড় কোন সমস্যা সমাধানের পর ওই ছোট্ট সমস্যাগুলোও হয়তো সমাধান হয়ে যায়। আবার কোন ক্ষেত্রে দেখা যায়, বড় উদ্যোগ নিয়ে বড় সমস্যাটি সমাধানই হচ্ছে না কোন একটি ছোট্ট সমস্যা কারণে। সেক্ষেত্রে আশু প্রয়োজন হয় ছোট্ট সমস্যাটিকে আমলে নেওয়া। তাই ক্ষুদ্র কোন জিনিসকে তাচ্ছিল্য করা নয়; ক্ষুদ্র কোন উদ্যোগকে অবহেলা করা নয় এবং ক্ষুদ্র কোন স্বপ্নকে মাড়িয়ে দেওয়া নয় বরং ক্ষুদ্র ও বৃহত্তম উভয়কেই গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ এই ক্ষুদ্র থেকেই যেমন বৃহত্তমের সৃষ্টি হয়; ঠিক তেমনি বৃহত্তমের প্রতিটি অঙ্গে ক্ষুদ্রতমের অস্তিত্ব থাকে। তাই তো কবি যর্থাথই বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকনা, বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তুলে মহাদেশ ও সাগর অতল।’
দুই
অনলাইন নিউজ পোর্টাল বারসিকনিউজ-এর যাত্রা শুরু হয়েছে ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ আধেয় দিয়ে। এই নিউজ পোর্টালে প্রখ্যাত ও বিখ্যাত কোন মানুষের উদ্যোগ দিয়ে শুরু হয়নি; বরং বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক, প্রবীণ ব্যক্তি, নারী, তরুণ ও এবং অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের উদ্যোগকে পুঁজি করেই যাত্রা শুরু করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকারহীন ও সাধারণ মানুষের এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোকে গুরুত্ব দিয়েই বিগত দেড় বছরে বারসিকনিউজ নিজেকে সজ্জিত করেছে। সাধারণ ও ছোট্ট এই উদ্যোগগুলোর সংখ্যা আজ এক হাজার (১০০০) ছাড়িয়ে গেছে! ইতিবাচক এই উদ্যোগগুলো নিয়ে বারসিকনিউজ এর নিরন্তর যাত্রা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এই অল্প সময়ের ভেতরে ১০০০ ইতিবাচক আধেয় ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করে যে, দেশে ইতিবাচক সংবাদের কোন ঘাটতি নেই; ঘাটতি রয়েছে আমাদের প্রচলিত সংবাদ নির্বাচন ও ফিল্টারিং প্রক্রিয়ায়! বারসিকনিউজ-এ ৫০০ আধেয় ছাড়িয়ে যাওয়ার সময়েও একটি লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখায় স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলাম যে, ‘বারসিকনিউজ-এ দেশের নেতিবাচক কোন সংবাদ ও ফিচারধর্মী লেখা নেই। ইতিবাচকতাকে পুঁজি করেই এই অনলাইনের সবগুলো লেখা তৈরি হয়েছে। দেশে ‘হার্ডনিউজ’ ছাড়াও অনেকগুলো ‘সফটনিউজ’ রয়েছে।’ ওই লেখায় বলেছিলাম, ‘আমাদের নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিকস মাধ্যমগুলোতে আমরা নেতিবাচক সংবাদে ঠাসা হতে দেখেছি। পত্রিকা খুললে বা অনলাইনগুলোতে ঢুঁ মারলেই প্রথমেই নেতিবাচক সংবাদ দিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানানো হয়। খুন-খারাবি, জমি দখল, ধর্ষণ, প্রতারণা, লুট, ডাকাতি, দুর্ঘটনার সংবাদগুলো দেখে দেখে আমাদের মানসপট নেতিবাচকতায় আক্রান্ত হয়েগেছে। প্রচলিত দৈনিক বা অনলাইনগুলোতে ইতিবাচক সংবাদ অবশ্যই আছে তবে সংখ্যায় অনেক কম। এসব সংবাদ কদাচিৎ ভালো ‘ট্রিটমেন্ট’ পায়।’ বিগত দেড় বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, দেশের বিখ্যাত, বড়, প্রখ্যাত ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীদের নিয়ে তৈরি সাদামাটা বা গভীর যেকোন ধরনের আধেয়গুলোকে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো কাড়াকাড়ি করে। কিন্ত কম প্রভাবশালী, ছোট্ট নামধারী, কম বিখ্যাত কোন গোষ্ঠীদের নিয়ে তৈরি আধেয়গুলোকে সেভাবে কাড়াকাড়ি হতে দেখা যায়নি! এতে গণমাধ্যমগুলোর কোন দোষ নেই। কারণ সংবাদপত্র বা অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোর সংবাদ উপাদানের নীতিমালাই হচ্ছে বড়, প্রখ্যাত, বিখ্যাত এবং দেশের মানুষের আবেদনকে নাড়া দেয় এমন সংবাদ নির্বাচনকে উৎসাহিত করে।
তিন
বারসিকনিউজে আমরা প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে ছোট্ট ও বড় উভয় সংবাদ উৎসকে গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ, জলবায়ু অভিযোজন, প্রশমন, সংস্কৃতি, উন্নয়ন উদ্যোগ, ব্যক্তি সাফল্য বিষয়ক সংবাদ ও ফিচার প্রকাশ করার চেষ্টা করে আসছি। প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ, জনউদ্যোগ, ব্যক্তি উদ্যোগ ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নসহ বিভিন্ন ইতিবাচক বিষয়ের সংবাদ ও ফিচার সংগ্রহ ও প্রকাশের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছি যে, ‘ছোট নামগুলোও সংবাদের উপাদান’ হয়। এই অনলাইনে এ পর্যন্ত প্রকাশিত যতগুলো সফলতা কাহিনী, ব্যক্তি ও জনউদ্যোগ, প্রাণ ও প্রকৃতিকে রক্ষা ও সংরক্ষণ, সামাজিক সমস্যা সমাধানে যুবদের সক্রিয় ও দায়িত্বশীল উদ্যোগগুলো কোন ‘বড় নামধারী’ মানুষ করেননি; করেছেন প্রচলিত ধারণায় ছোট ছোট নামধারী মানুষগুলো! তাঁরা কেউ হয়তো প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক, জেলে, যুবক, শিক্ষক, আদিবাসী, নারী। সবাইকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েই বারসিকনিউজ এগিয়ে যেতে চায়। তবে এটা ঠিক যে, বারসিকনিউজ-এর মাধ্যমে আমরা মূলত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোই সন্ধান করার চেষ্টা করি, যেগুলো মানুষের দৃষ্টির আড়ালে পড়ে আছে। আমরা সেগুলোকে আলোতে, প্রচারে নিয়ে আসতে চেয়েছি। কারণ আমরা মনে করি, এই ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো বড় উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথ ও কৌশল বাতলে দিতে পারে, উন্মোচিত করতে পারে দারুণ সম্ভাবনার দ্বার। কারণ ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তমের জন্ম হয়। ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র উদ্যোগ, সংবাদ, তথ্য সৃষ্টি করে উন্নয়নের বিশাল মহাসড়ক, গড়ে তুলে বিশাল তথ্যভান্ডার!
বারসিকনিউজ-এ এ পর্যন্ত প্রকাশিত এক হাজার অধিক উন্নয়ন বিষয়ক আধেয়গুলো নিশ্চয়ই কোন না কোন মানুষকে উৎসাহিত করেছে, প্রেরণা দিয়েছে এবং উদ্যোগী করেছে ইতিবাচক পরিবর্তন রচনায় ভূমিকা রাখতে। এসব মানুষের সম্মিলিত উন্নয়ন উদ্যোগগুলোকে নিয়েই একটি বড় উন্নয়ন এবং একটি বড় ইতিবাচক পরিবর্তন সমাজ ও রাষ্ট্রে সাধন করা সম্ভব; তাদের উদ্যোগকে বাদ দিয়ে নয়। আমরা মনে করি, এখনও বাংলাদেশের আনাচে, কানাচে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেকগুলো ক্ষুদ্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন উদ্যোগ রয়েছে যেগুলো প্রচারের আলোতে আসেনি কিংবা প্রচারের আলোতে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। আসুন আমরা এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোকে আমলে নিয়ে এগুলোর প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখি। এই সব ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোকে সমন্বিত করেই আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করতে চাই।
ছবি: সংগৃহীত