যারা কুড়ানো শাকসবজিকে বাঁচাতে পারেন তাদের কোন মাথাব্যাথা নাই আবার যারা এগুলোকে বাঁচাতে চান তাদের সামর্থ্য নাই: কাশেম আলী

কাশেম আলী। বসবাস করেন মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার ল্যাসরাগঞ্জে। তাঁর বসবাসের জায়গাটিকে চারদিক থেকেই ঘিরে রেখেছে পদ্মা নদী। কেউ এটাকে বলে চর, কেউ বলে নদী সিকস্ত জমি, আবার কারো কারো কাছে জায়গাটার পরিচয় খাস জমি হিসেবে। সে যাই হোক, ৫টি ইউনিয়ন এর প্রায় ১০০ গ্রাম রয়েছে এই চরের ভেতর। তার একটিতেই কাশেম আলীর বসবাস। মরমী সাধনায় ব্রত হয়েছেন বলে সংসার রেখে বিবাগী জীবন পার করেন বেশিরভাগ সময়। সরকারি আশ্রয়ন প্রকল্পের ছোট্ট একটি ঘরে ঠাঁই হয়েছে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের। অচাষকৃত উদ্ভিদ বিষয়ে একটি গবেষণা কাজে বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় এই বিষয়েই হঠাৎ আড্ডা জমে ওঠে একসময় পেশায় ট্রাক ড্রাইভার সংসার বিবাগী এই মানুষটার সাথে। পতিত জমির অভাব, কুড়ানো শাকসবজিকে আগাছা হিসেবে চিহ্নিত, এসব উদ্ভিদগুলোকে সংরক্ষণ বা রক্ষা করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছল কৃষকের অনীহা এবং দরিদ্র মানুষের (যাঁরা এ উদ্ভিদগুলো বাঁচাতে চান, তাঁদের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণের জন্য) অসমার্থ্যতার কারণেই কুড়ানো শাকসবজিগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে বলে তিনি মনে করেন। তাঁর সাথে আলাপচারিতায় যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তার ভাবনাগুলো নিয়েই হাফিজ শিশির এই লেখাটি তৈরি করেছেন –

Untitledপ্রকৃতিতে কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কেন কমে যাচ্ছে জানতে চাইলে কাশেম আলী বলেন, “আগের দিনে মানুষ কুড়ানো শাক (অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ) বেশি খেত। এখন তো প্রাকৃতিক উৎসগুলো কমে যাচ্ছে। জমিতে চাষ করে চাহিদা পূরণ করতে হয়। আমার মনে হয় কুড়ানো শাক কমে যাবার মূল কারণ হলো আবহাওয়ার পরিবর্তন। আগে প্রচুর বৃষ্টি হত। এখন আর তা হয় না। এছাড়া এখন মানুষের সংখ্যা বেশি, গবাদি পশুর সংখ্যা বেশি, চাষের জমি কমে যাচ্ছে ইত্যাদি কারণে কমে যাচ্ছে এই সকল শাকসবজি। আগে তো অনেক পতিত জমি ছিলো, ঝোপ-জঙ্গল ছিলো। ফলে এই সকল শাকসবজি বেশি হতো। আর এখন ওইগুলো না থাকায় কুড়ানো শাকসবজি কমে যাচ্ছে।”

এই কথাগুলো বলেই থামলেন না। কথা এগিয়ে চলল আরো, আরো ছোটছোট গলিপথ ধরে। একে একে ব্যাখ্যা করলেন অচাষকৃত উদ্ভিদ কমে যাবার বিভিন্ন কারণ।

“জমি চাষ করার ফলে কুড়ানো শাক মরে যাচ্ছে বা সেগুলোকে তুলে ফেলা হচ্ছে খুব ছোট থাকতেই। একটা অনাবাদী জমিতে যখন কেউ ফসল করবে, তখন তো আগাছাগুলোকে (অচাষকৃত শাকসবজিকে অনেকে আগাছা হিসেবেই দেখেন) তারা ধ্বংস করবে মূল ফসলের ভালো ফলনের জন্য। কারণ ওটার (অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ) কোন বেচাকেনা সাধারণত হয় না। সাধারণ, গরিব মানুষ, গরু-ছাগল-ভেড়া এগুলো খায়।” তিনি বলেন, “ফসল চাষ করায় মানুষ আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হচ্ছে। সুতরাং মূল ফসল যখন হবে তখন তারা এগুলোকে কাঁচি দিয়ে পরিষ্কার করে দেবে। নতুন আর একটা ফসল করার সময় মানুষ এই উদ্ভিদগুলোকে মেরে ফেলবে বিষ বা কীটনাশক দিয়ে। নতুন ফসল চাষ করার প্রয়োজনেই মানুষকে এটা তুলে ফেলতে হচ্ছে বা ধ্বংস করে ফেলতে হচ্ছে। ফলে ফসলের মাঠের কুড়ানো শাক আর থাকছে না। অনাবাদী জমি বা রাস্তার পাশে যে শাক হচ্ছে, সেটাই গরিব মানুষ খেতে পারছে!”

কথা শুনে একটু বিভ্রান্ত হলাম, তিনি কি এই শাকসবজিগুলোকে অপ্রয়োজনীয় বা অলাভজনক বলতে চাচ্ছেন? ভুল ভাঙল তাঁর পরের কথা শুনে।

তিনি বললেন, “আপনার বিশ বিঘা-পঞ্চাশ বিঘা-একশ বিঘা জমি আছে। আপনি তো আমার কথা ভাবছেন না। আপনি তো শুধু আপনার আখের গোছানোর চিন্তায় আছেন। সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হল কি না হলো, তা নিয়ে তো আপনার কোন মাথা ব্যাথা নাই। আপনি যখন শুধু আপনার চিন্তা করছেন, তখন সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। আর তখনই সে সম্ভব হোক আর না হোক, বাজার থেকে শাকসবজি কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষ পুষ্টিহীন হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে ধরেন ১৫% মানুষ নিজের সঠিক খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। বাকি ৮৫ জন মানুষই তো গরিব। তারা নিজের খাদ্য চাহিদা পূরণে সক্ষম না। আর খাদ্য চাহিদা পূরণ ঠিকমত করতে না পারলে পুষ্টি আসবে কোথা থেকে? দেখা যাচ্ছে যে, অত্যন্ত দরিদ্র মানুষগুলো খাবারের অভাবে বাধ্য হয়ে এই খাবারগুলো খাচ্ছে।” তিনি বললেন, “আপনি শাকসবজি খেলে সপ্তাহে না হয় একদিন খাবেন বা দুইদিন খাবেন। প্রতিদিনই কি খাবেন! আমাদের এই চরে এমনও পরিবার আছে, যারা সপ্তাহে চারদিন, পাঁচদিন বা সাতদিনই এইসব শাকসবজি খাচ্ছে। দেখা গেল বাড়িতে চাল আছে, কিন্তু বাজার নাই-তখন একটু শাক তুলে এনে রান্না করছে। কোনদিন ভাজি বা কোন দিন ভর্তা। ঐবেলার খাবারটা তো অন্তত হয়ে গেলো। কিন্তু আপনি যখন এই শাকসবজিগুলোকে বিষ দিয়ে বা নিড়ানি দিয়ে ধ্বংস করে ফেলছেন, তখন এই দরিদ্র মানুষগুলো আরো বেশি অসহায় হয়ে পড়ছে। আপনার জমিতে আপনি যা করবেন, আমি তো তাতে কোন কথা বলতে পারব না। আবার এই শাকসবজিগুলো যদি পুরোপুরি হারিয়ে যায় কখনো, (গরিব মানুষ) না খেয়ে মরে যাবে বলব না, তবে তখন উপরওয়ালার দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া এই মানুষগুলোর আর কিছুই করার থাকবে না। মানুষ তো চাইলেই সবকিছু করতে পারে না। আর এই গরিব মানুষগুলোর ক্ষমতা আরো কম।”

মানুষ এই শাকসবজিকে ধ্বংস করে ফেলছে কেন, এগুলো সংরক্ষণ বা বাঁচিয়ে রাখলে তো আমাদের খাদ্য চাহিদার অনেকটা পূরণ হতে পারত? প্রশ্ন করলাম তাঁকে।

কাশেম আলী বলেন, “লালশাক, পালংশাক এগুলো তো আগে চাষ হত কম। আগে এত ধরণের শাক পাওয়া যেত না। বর্তমানে গ্রামের মানুষ বিভিন্ন ধরনের স্বাদ নিতে গিয়ে এই শাক (অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ) কম খাচ্ছে। কুড়ানো শাক এর বেচাকেনা সাধারণত হয় না। সবাই এখন টাকা দিয়েই সবকিছুর দাম বিচার করে। তারপর এইটা তো গরিব মানুষের খাবার, যাদের কোন জমি জমা নাই। যাদের ক্ষেত আছে, তারা এটা কম খায়। তারা ইচ্ছামত শাকসবজি খাচ্ছে। যেটা মন চাচ্ছে সেটাই করছে। স্বাদ পরিবর্তনের জন্য কুড়ানো শাক মাঝেমাঝে খাচ্ছে। তাদের তো কেনারও সামর্থ্য আছে।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের বয়সী যারা, আমাদের ছোটবেলায় তো এই শাকসবজি খাওয়া বাধ্যতামূলক ছিলো। প্রতিদিই প্রায় এগুলোই খেতে হত। একই ধরনে খাবার তো মানুষের প্রতিদিন খেতে ভালো লাগে না। তাই সামর্থ্য বাড়ার সাথে সাথে মানুষ এগুলো খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। বাবা-মাকে স্বাদ নিয়ে খেতে দেখেনি বলে হয়তো আমাদের সন্তানদের কাছেও এই শাক আর ভালো লাগে না। সব মিলিয়ে বুঝতে পারছেন তো, যারা এটাকে বাঁচাতে পারে তাদের এটা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নাই আর যাদের এটা দরকার তাদের সামর্থ্য নাই এগুলোকে রক্ষা করার। সেজন্যেই আগে যেভাবে পাওয়া যেত বা যে পরিমাণে পাওয়া যেত এখন আর সে পরিমাণে পাওয়া যায় না।”

আরো অনেক কথাই হলো তাঁর সাথে। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম কথাগুলো! ফেরার পথে ভাবছিলাম, আমরা সবাই যদি এভাবে ভাবতে পারতাম!

happy wheels 2

Comments