কৃষকের চোখে লক্ষ্মী কিন্তু কৃষির ভাষায় ধানের ফলস স্মাট রোগ
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রংজলবায়ু পরিবর্তন শব্দটি বর্তমান সময়ের অন্যতম ব্যবহৃত শব্দ। বাংলাদেশসহ পৃথিবীজুড়েই সব মহল ও টেবিলে টেবিলে জলবায়ু পরিবর্তন অলোচনার বিষয়। এটি একটি বৈশ্বিক হট কেক ইস্যু। অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আলোচনার কারণও রয়েছে। আর আলোচনার অন্যতম কারণের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের উপর এর বিরূপ প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের অস্তিত্ব হুমকির মূখে, এমনকি পৃথিবীর মানচিত্রও পরিবর্তনের উপক্রম। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তৃতীয় বিশ্বের ভাটি অঞ্চলের দেশগুলো অস্তিত্ব সবচেয়ে বেশি হুমকির মূখে রয়েছে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের কৃষি, পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে শীতের প্রকোপ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের অন্যতম কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতি খরা, অতি বৃষ্টি, আগাম বৃষ্টি, বন্যা, জলাবদ্ধতা, ঢল, বজ্রপাত, ঝড়, অসময়ে বৃষ্টি, শীতের প্রকোপ ইত্যাদি কারণে প্রতিবছর এদেশের কৃষি, পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যে ব্যাপক ক্ষতির সন্মূখীন হচ্ছে। এ বছর আমান মৌসুমের ধানে বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই হয়েছে বলে বিশেজ্ঞদের ধারণা। আমন ধান রোপণের পর থেকে পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ, লিফ ব্লাষ্ট, পাতা পোড়া রোগ, গোড়া পঁচা রোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই মোকাবেলা করতে হয়েছে আমাদের দেশের কৃষকদেরকে।
এসব রোগ-বালাই কৃষকরা কিছুটা মোকাবেলা করতে সক্ষম হলেও ধানের শীষ বের হওয়ার পর চাল ভরার মূহুর্তে আরও একটি সমস্যা/রোগ দেখা দেয় ধানের শীষে। এ রোগটি মূলত ধানে চাল ভরার সময়ে দেখা দেয়। কৃষিবিদদের মতে, এটি মূলত ছত্রাকের আক্রমণজনিত রোগ। কৃষকদের ভাষায় এটি লক্ষ্মীর গু বা ভূয়াঝুল। কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় এটি ফলস স্মাট রোগ। এক ধরনের ছত্রাক ধানে চাল হওয়ার শুরুতেই আক্রমণ করে এবং বাড়ন্ত চালকে নষ্ট করে বড় কালো রঙের গুটিকা সৃষ্টি করে। গুটিকার ভেতরের অংশ হলদে কমলা রঙ এবং বহিরাবরণ সবুজ অথবা কাল হয়। কচি গুটিকাগুলো ১ সেমি. এবং পরিপক্ক অবস্থায় আরও বড় হয়। সাধারণত একটি শীষের কয়েকটি (৮/১০টি) দানায় এটির আক্রমণ হয়। চলতি বছর আমন মৌসুমে ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রায় সব এলাকাতেই এই রোগটির কম-বেশি আক্রমণ লক্ষ্য করা গেছে। তবে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সীমান্ত এলাকার স্থানীয় জাতের ধানের জমিতে এ রোগের প্রাদর্ৃুভাব বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে নালিতাবাড়ী উপজেলার কৃষক সেন্টু হাজং বলেন, “এটি একটি রোগ কিনা জানিনা, তবে বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছি এটি নাকি লক্ষ্মীর গু। কোন জমির ধানের শীষে লক্ষ্মীর গু দেখা দিলে নাকি সে বছর ঐ জমিতে ধানের ফলন ভালো হয়।’
নালিতাবাড়ী উপজেলায় দেখা গোছে একটি জমির ধানের (তুলসীমালা) প্রায় সকল শীষেই এ রোগটি হয়েছে। একটি শীষে প্রায় ২০-২৫টি করে গুটি দেখা গেছে। উল্লেখ্য যে, এ গুটিগুলো মূলত পুষ্ট ধানের দানাতেই হয়েছে। কৃষকরা এটিকে ভালো ফলনের লক্ষণ বললেও এর ফলে প্রচুর পরিমাণে ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা ফলন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। তাই এ রোগটি দেখা দেয়ার সাথে সাথে এর প্রতিকারের উদ্যোগ কৃষকদেরকে নিতে হবে। কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ রোগের প্রতিকারের কোন উপায় তাদের জানা নেই।
এছাড়া কৃষকরা লক্ষ্মীর গুকে ভালো ফলনের নির্দেশক মনে করায় এ রোগটি প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা তারা নেয় না। কোন কোন অঞ্চলে (জামালপুর) এ রোগটিকে প্রাকৃতিক খৈ বলা হয়। ধানের এ গুটি ভাঙার পর ভেতরে সাদা যে অংশটি পাওয়া যায় তাকে জামালপুর অঞ্চলের মানুষ খৈ বলে। ছোট ছোট বাচ্চারা এটি খৈ মনে করে খায় এবং খেতেও নাকি ভালো লাগে। এ রোগ প্রতিকারের উপায় এ রোগের প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে কৃষিবিদ সাইফুল আযম খান (উপ পরিচালক কৃষি-জামলপুর) এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ধানের ফলস স্মাট রোগটি সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিকার করা সম্ভব। কৃষি বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী নিম্নোক্ত উপায়ে এ রোগটির ব্যবস্থাপনা করা যায়। ১. আক্রান্ত ধান গাছ ও শীষ তুলে ফেলা এ রোগ দমনের সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। সকালবেলা আক্রান্ত শীষ পলি ব্যাগে সাবধানে আবদ্ধ করে গাছ তুলতে হবে যাতে স্পোর ছড়াতে না পারে।২. ক্ষেত আক্রন্ত হবার আশংকা থাকলে শীষ বের হবার পরই জমিতে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাক নাশক যেমন ঃ ব্যাভিস্টিম বা নোইন ১ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
পরবর্তীতে কৃষকরা যা করবেন না ১. আক্রান্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করবেন না।
পরবর্তীতে কৃষকরা যা করবেন ১. ফসল কাটার পর আক্রান্ত জমি ও তার আশেপাশের জমির নাড়া পুড়িয়ে ফেলা।
স্থানীয় জাতের ধানের একটি শীষে (তুলসীমালা, কালিজিরা, চিনিগুড়া ইত্যাদি জাতের ধানে) গড়ে ২৫০টি দানা হয় (কোন কোনটিতে ৩০০শতাধিক দানা হয়)। ২০১৭ সালের আমন মৌসুমে স্থানীয় জাতের একটি ধানের শীষে ৮/১০টি দানায় ফলস স্মাট বা লক্ষ্মীর গু রোগটি দেখা গেছে। পুষ্ট ধানের দানায় এটি হওয়ায় ধানের গড় ফলনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই লক্ষ্মীর গু রোগটিকে ভালো ফলনের নির্দেশক মনে না করে কৃষকদের উচিত হবে ধানের জমিতে দেখা দেয়ার সাথে সাথে এটিকে রোগ হিসেবে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা, তাহলেই হয়তো কৃষকরা এ রোগে ক্ষতির হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে সক্ষম হবে। এ রোগ সম্পর্কে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এগিয়ে আসতে হবে কৃষি অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্মরত এনজিওদেরকে।