সুইপারদের অবদানকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
মানুষ কাঁচ, ভাঙা চোরা জিনিসপাতি ডেনের মদ্যি ফালায়। ডেনে কাম করার সময় হাতে কাঁচ ঢোকে। জুতো নাই। পায়ে ও কাঁচ ঢোকে। পাও কাট্যা ফাঁক হয়া যায়। এই দ্যাখেন, হাতে ৬ ডা শিলাই। ড্রেনে নামার সময় স্লাপের ধাক্কায় মাথাডা কাট্যা গ্যাছে। তাও কাম করত্যাছি। পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের কাজী পাড়া মহল্লার সুইপার (পরিচ্ছন্ন কর্মী) বিশু (৫০) সম্প্রতি পৌরসভার আফ্রাতপাড়া মহল্লায় খালি গায়ে পয় নিষ্কাশন ড্রেন পরিষ্কার করার সময় মাথায় বাঁধা লাল রঙের গামছাটা খুলে কেটে যাওয়া ক্ষত স্থান ও হাতের শেলাইয়ের দাগ দেখান।
তার দীর্ঘশ্বাস, কষ্ট বেদনার কথা যেমন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছিল তেমন করে তখন ও শরীরের সাথে মেলেনি কেটে যাওয়া ক্ষতস্থানের রক্ত। লাল রক্ত গায়ের সাথে লেপ্টে কালচে রঙ ধারণ করেছে তখন। চা খাওয়ার প্রস্তাব দিলে কোমড়ের সাথে রশি দিয়ে আটকে রাখা ছেড়া প্যান্টটি ঝেড়ে ঝুড়ে পরিষ্কার করে অপর সুইপার (পরিচ্ছন্ন কর্মী) চৈতন্যকে সাথে নিয়ে পাশের চায়ের দোকানে আসেন বিশু।
হাতে পায়ে ড্রেনের ময়লা লেগে থাকায় চায়ের দোকানে না ঢুকে দোকানের সামনে রাস্তার পাশে দাঁড়ান। তিনটে চায়ের অর্ডার পেয়ে চায়ের দোকানদার ব্যস্ত হয়ে পরেন চা তৈরির কাজে। অন্যদের কাপে চা দিলেও বিশু আর চৈতন্যেও জন্য গ্লাসে চা বানান দোকানদার। কথায় কথায় পরিচ্ছন্ন কর্মীদের কাপের বদলে পৃৃথক গ্লাসে চা দেওয়ার প্রসঙ্গ চলে আসলে বিশু বলেন, “ড্রেনের ভিতর নোংড়া কাম করি। আমারে কাপে চা দিলি মানুষ নিষেধ করে। তাই আমারে গ্লাসে চা দেয়”। তিনি আরো বলেন, “তিন ছাওয়াল আর এক মিয়্যা আমার। ছাওয়াল গাড়ে পৃথক সংসার হলিউ কেউ কাম করব্যার চায় না। ওগারেও আমারি দেখা লাগে। পৌরসভার বেতন পাই ৬ হাজার টেকা। দিন ২ শ’ টেকা। পতিদিন চার পাঁচশ টেকা খরচ লাগে। কি করব কন? তাই রাতি অটো ভ্যান চালাই।”
একই মহল্লার চৈতন্য মালী (৪৫) চার বছর যাবত চাটমোহর পৌরসভায় সুইপার হিসেবে কাজ করছেন। চৈতন্য বলেন, “পৌরসভায় সুইপারের কাজ করে ৬ হাজার টাকা বেতন পাই। সুইপারের কাজ কার বলে অনেকে আমাদের খারাপ চোখে দেখে। অনেক বাড়ির মল মূত্রের লাইন পৌরসভার ডেনের সাথে যুক্ত। মলমূত্র পরিত্যক্ত জিনিসপত্রাদি মানুষ ডেনের মদ্যি ফালায়। সেগুলো আমাদের পরিষ্কার করতে হয়। পরিষ্কার না করলে ডেন ভর্যা যায়। পানি নিষ্কাশন হয় না। লোকজনের অসুবিধা হয়।”
তিনি আরো বলেন, “দুই ছেলে এক মেয়ে আমার। ছেলেরা বিয়ে করেছে। ওদের পৃথক সংসার। মানুষের কাছে হাত পেতে চেয়ে চিন্তে ৬০ হাজার টাকা যৌতুকে মেয়ে চিন্তা মালীকে নাটোরের দয়রামপুর এলাকায় বিয়ে দিয়েছি। বাবা মা নেই আমার। শ^শুর শ্বাশুরী থাকলেও তাদের সহায়তা করার মতো কেউ না থাকায় তাদের ও দেখাশনা করি। যে ৬ হাজার টাকা বেতন পাই তা দিয়ে চাল ডাল ওষুধপত্র নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য সব কিছু কিনতে হয়। সব মিলে কোন মতে দিন পার করছি।”
ঝাঁড়ুদার খোকন বাঁশ ফোর বলেন, “পৌরসভায় ঝাঁড়–দারের কাজ করে সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতন পাই। এ বেতনে সংসার চলে না তাই বাধ্য হয়ে অন্যান্য জায়গায় সুইপারের কাজ করি। মা ফুলমতি বাঁশফোর (৬০), স্ত্রী স্মৃতি বাঁশফোরসহ দুই ছেলে মেয়ে মোট ৫ জনের সংসারের ভরণপোষণ করতে হয় আমাকে। বড় মেয়ে খুশী বাঁশফোর চাটমোহর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়ছে। ছেলে রাজ বাঁশফোর ডি এ জয়েন উদ্দিন স্কুলে ২য় শ্রেণীতে পড়ছে। তিনি আরও বলেন, “মেয়ের কোচিং ফি ১২শ’ টাকাসহ লেখাপড়া বাবদ খরচ মাসে ১৬শ’ টাকা। ছেলের লেখাপড়া বাবদ ও মাসে ৬ থেকে ৭শ’ টাকা খরচ। এ ছাড়া দৈনিক প্রায় ২শ’ টাকা সংসার খরচ। বাধ্য হয়ে তাই আমাকে অন্যত্র টয়লেট পরিষ্কার করতে যেতে হয়। থাকার মত নিজস্ব কোন জায়গা নেই। চাটমোহর থানার পেছনের পৌরসভার পানি সাপ্লাইয়ের ডিপ টিউবওয়েলের ঘরে থাকি। আমার মতো অন্যান্য কয়েক ঘর বাঁশফোর সম্প্রদায়ের মানুষ চাটমোহরে বসবাস করে আসছে। এদের কেউ রেল লাইনের ধারে, কেউ পুরাতন বাজারের পাশের পরিত্যক্ত ও ঝঁকিপূর্ণ বিএস কোয়ার্টারে বসবাস করছে।”
শহর পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে নিয়োজিত বিশু, চৈতন্য ও খোকনদের মতো ব্যক্তিদের আমরা অনেকেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি। ওদের কেউ সুইপার, কেউ ঝাঁড়–দার আবার কেউ হরিজন বলে থাকি। কেউ কেউ মেথরও বলে থাকি। আমরা যারা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি তাদের অনেকেই সভ্যতার উৎকর্ষে ভূমিকা না রাখলেও যুগ যুগ ধরে সমাজের উৎকর্ষে ভূমিকা রেখে চলছে এই মেথর সম্প্রদায়। ওদের জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে কবিতা, নাটক, সিনেমা। আমরা এগুলো পড়ে বা দেখে আবেগাপ্লুত না হয়ে স্থায়ীভাবে ওঁদের ভালোবাসতে শিখি। ওঁরা যে নিজেদের অপরিচ্ছন্ন করে আমাদের পরিচ্ছন্ন রাখছে, আমাদের শহরকে সুন্দর রাখতে ভূমিকা রাখছে। ওদের অবদানকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই।