বৈচিত্র্যময় ফসল চাষী সুমন মিয়া
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
সাধারণভাবে কৃষি বলতে মানুষ ধান ফসলকেই বুঝে থাকেন। কিন্তু এর বাইরেও যে সকল শস্য আবাদ করা হয় সেগুলোও কৃষির অন্তর্ভূক্ত। তবে আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ‘ভাত’ বলেই হয়তো এ ধরণের ভাবনাটা আসে। কিন্তু ধান ছাড়াও আমাদের চারপাশে অনেক ধরণের ফসল চাষ হতে দেখা যায়। যেমন বিভিন্ন জাতের সব্জী, ডাল জাতীয় শস্য, তেলবীজ ইত্যাদি। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল হচ্ছে আখ বা ইক্ষু। যে ফসলটি হয়তো অন্যান্য ফসলের মতো সচরাচর চাষ হতে দেখা যায় না। অঞ্চলভেদে এর বিভিন্ন নাম হয়ে থাকে। যেমন কুশাইল, গেণ্ডারি, উখ্ ইত্যাদি।
ব্যতিক্রমী একজন কৃষক মো. সুমন মিয়া। তিনি প্রায় ৮ বছর যাবৎ তাঁর জমিতে আখ চাষ করে আসছেন। লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের সুলতানগাতী গ্রামে তিনি বাস করেন। পৈতৃকসূত্রে তিনি প্রায় ৩ বিঘা জমির মালিক। কৃষিকাজ শিখেছিলেন বাবার কাছেই। সে অনেক বছর আগের কথা। কিন্তু বর্তমানে কৃষিকাজে তিনি সিদ্ধহস্ত। সুলতানগাতী গ্রামে সবচে’ বেশি জমির মালিক তাঁর পরিবার। যে কারণে প্রতিবছর ধান ছাড়াও সকল সব্জী চাষ করেন তাঁদের জমিতে। মরিচ, পাট, মাসকলাইয়ের মতো ফসল তিনি চাষ করেন, যা কিনা এই গ্রামের অন্য কোনো কৃষক করেন না। নিজেদের খাওয়া বাদেও প্রতি মৌসুমে অনেক টাকার সব্জী তিনি বিক্রি করতে পারেন। সকল বীজ তিনি নিজে সংরক্ষণ করেন।
প্রায় ৪ বছর আগে তাঁর এক প্রতিবেশি বাজার থেকে আখ কিনে এনেছিলেন। প্রতিবেশির ফেলে দেয়া আখের অগ্রভাগের অংশটুকু তিনি চেয়ে নিয়ে আসেন। নিজ বাড়ির পুকুর পাড়ে তা রোপণ করে রাখেন। কিছুদিন পরে দেখন সেই অংশ থেকে অনেকগুলো কুশি বের হয়েছে। সেই কুশিগুলো তুলে নিয়ে মাত্র ৩ শতাংশ জমিতে রোপণ করেন। এভাইে শুরু হয় সুমনের আখ চাষ। সেই জমিতে পাঁচ বছর একনাগাড়ে আখ চাষের পর তিনি ৫০ শতাংশ জমি কিনেন। এই জমি তিনি আখ বিক্রির লাভের টাকা জমিয়ে কিনেছেন। সেখানেও তিনি শুধুমাত্র আখ চাষ করেন।
এত বছর আখ চাষ করে তিনি হিসেব করে দেখেছেন যে ধান বা সব্জীর চাইতে আখ চাষে লাভ বেশি হয়, সেই তুলনায় পরিশ্রম কম। জমিটি দু’বার চাষ দিয়ে কেইল করে আখের কুশিগুলো রোপণ করে দিতে হয়। এক সপ্তাহ পর সার দিয়ে দেন। পোকা যদি ধরে তবে কীটনাশক দিতে হয়। মাঝে মাঝে পানি সেচ দিলে ভালো হয়। এরপর আগাছা পরিষ্কার। তবে আখ যখন ছোট থাকে তখনই শুধু আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। বড় হলে আর লাগে না। আখের গাছটি সোজা করার জন্য সুমন মাঝে মাঝে গাছের পাতা ভেঙ্গে দেন। তবে তাঁর জমির পরিমাণ বেশি বলে পরিশ্রম একটু বেশি করতে হয়। কিন্তু সেই পরিমাণ তাঁর লাভও হয়।
বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠ মাসে আখের কুশি রোপণ করলে তা ভাদ্র মাসেই খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে যায়। তিনি গে-ারি জাতের আখ চাষ করেন। ভাদ্র থেকে শুরু করে ফাল্গুন/চৈত্র মাস পর্যন্ত তিনি আখ বিক্রি করতে পারেন। তাঁর প্রতিটি আখ ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি করেন। তবে পার্শ্ববতী মদনপুর গ্রামের পূর্ণ্যরি সময় আখের দাম বেশি পাওয়া যায়। সে সময় প্রতিটি আখ ৮০-১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন। নিজস্ব ভ্যান গাড়ি করে তিনি এলাকার বিভিন্ন বাজারে গিয়ে পাইকারী ও খুচরা বিক্রি করেন। ওই এলাকায় একমাত্র তিনিই আখ চাষ করেন বলে চাহিদাও বেশি। অনেক পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা তাঁর কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
৫০ শতাংশ জমি চাষ করতে তাঁর খরচ তেমন হয় না। কারণ বীজ, সার বা কীটনাশক তাঁকে কিনতে হয় না। এই জমি থেকে আখ বিক্রি করে প্রতিবছর তিনি প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করতে পারেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনসাপূজা, গণেশ পূজাসহ বিভিন্ন পূজাতে আখের প্রয়োজন হয়। সে সময় বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেকে এসে তাঁর বাড়ি থেকে আখ সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। ধর্মীয় প্রয়োজন ছাড়াও আখের অনেক ঔষধি গুনাগুণ রয়েছে। আখের রস জন্ডিসের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রোগীর পথ্য হিসেবে এটি খাওয়া যায়। আবার এর রস খেলে শারীরিক দূর্বলতা কাটে। তাছাড়া আখের ছোবড়া জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
গতানুগতিক চাষ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সুমন মিয়ার মতো যদি কৃষকরা ভিন্ন ধরণের ফসল চাষ করার দিকে আগ্রহী হতেন, তবে বৈচিত্র্যময় ফসল সম্ভারে আমাদের প্রকৃতি ভরে থাকতো। পোকা মাকড়ের আক্রমণ কমে যেতো। মাঠে মাঠে দোলা দিয়ে যেতো নানা রঙের হাওয়া। সুজলা, সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশ আবার গড়ে উঠতো।