ভালোবাসি ভালোবাসি
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
ভালোবাসার অনেক রঙ, অনেক ধরণেরও হয়। সন্তান তার মা বাবাকে ভালোবাসে। ভাই বোনের ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা। আবার প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা। ভালোবাসা হলো এক ধরণের অনুভূতি। এই অনুভূতি একেক জনের কাছে একেক রকম। বর্তমান সময়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ভ্যালেন্টাইন্স ডে পৃথিবীতে ভালোবাসাকে নতুনরূপে উপস্থাপন করছে। তবে সারাদিন রাস্তা বা পার্কে ঘুরে, অনেক টাকার দামী উপহার কিনে প্রিয়জনকে দেওয়াই কিন্তু ভালোবাসার একমাত্র প্রকাশ হতে পারে না!
পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে আজ অব্দি ভালোবাসাতো ছিলই, আছে, থাকবে। একজন মানুষ হিসেবে অন্য একজন মানুষকে ভালোবাসা মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। কেউ নিজের পরিবারের বিশেষ কাউকে ভালোবাসে। সেটা হতে পারে ছোট বোন বা ভাই। কেউ আবার ভালোবাসে নিজের শিক্ষককে। সেই ভালোবাসায় থাকে শ্রদ্ধা। আবার কারো জীবনে এমন কেউ থাকে যার জন্য সে অনুপ্রেরণা পায়, জীবনে সামনের দিকে এগিয়ে চলার সাহস পায় তাকেও তো ভালোবাসা যায় ? সেখানেওতো শ্রদ্ধা থাকে, ভরসা আর বিশ্বাস থাকে। দেয়া নেয়ার কোনো বিষয় স্থান পায়না।
কিন্তু ভালোবাসা কি শুধুই একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার জিনিস। আমাদের দেশটা এমন একটা দেশ যেখানে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, সম্প্রদায়ের মানুষ মিলে মিশে বসবাস করে। সেখানেও এক ধরণের ভালোবাসা আছে। প্রয়োজন আর ভরসার ভালোবাসা।
আমাদের চারপাশে কত অসহায়, দরিদ্র মানুষ আছে। ভালোবাসা প্রদর্শন যদি একটি দিনেরই হয় তবে কি আমরা পারিনা নিজের পরিবারের বাইরে গিয়ে সেই মানুষগুলোকে ভালোবাসতে? লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের আতকাপাড়া গ্রামের নবীন একতা সংঘ নামে একটি যুব সংগঠন আছে। সেই সংগঠনের সদস্যরা এই ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে ব্যতিক্রমী একটি উদ্যোগ নিয়েছে। এই দিনে তারা নিজ গ্রামের দুজন প্রবীণ নারীকে সম্মাননা প্রদান এবং চারজন দরিদ্র শিক্ষার্থীর মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেছে।
একজন নারী পালিশের মায়ের বয়স ১০৫ বছর। ছোট বেলা থেকেই অনেক দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে এখনো বেঁচে আছেন। তিনি জীবনে কোনোদিন নতুন শাড়ি কিনতে পারেননি। তাঁর জন্য একটি নতুন শাড়ি কিনে দেয়ার কথা বলা হলে অন্য একজন প্রবীণ নারী রাজুর মাও (৯৪ বছর) যুবকদের কাছে আবদার করেন নতুন শাড়ির জন্য। তিনি বলেন, ‘জীবনডা তো শেষই, অহন আল্লার ডাকের অপেক্ষায় আছি বাজান। মরার আগে একটা ভালা কাপড় পইরা মরতে পারলে মন্ডাত শান্তি পাইতাম।’
প্রবীণ নারীদের পছন্দ ও চাহিদার কথা বিবেচনা করে বারসিক’র সহযোগিতায় তাঁদেরকে সম্মাননা হিসেবে দুটি শাড়ি প্রদান করা হয়। এছাড়া চারজন দরিদ্র শিক্ষার্থীর মধ্যে দুজনকে দুটি স্কুল ড্রেস ও অন্য দুজনকে দুটি পাঠ সহায়িকা বই কিনে দেয়া হয়েছে। এই চারজন শিক্ষার্থীর কারো বাবা নেই। তারা অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আতকাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহাবুবুল আলম।
তিনি যুবকদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে আমরা বড় বেশি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি। অন্যদের নিয়ে ভাবার কথা মনেও আসেনা। যে কোনো বিষয়ের নেতিবাচক দিকটাই আগে দেখি। এই নেতিবাচকতার কারণে আমাদের ভালো দিকগুলো চাপা পড়ে যায়। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা ও প্রবীণ ব্যক্তিদের সন্মান জানাতে আজকের দিনটিকে বেছে নেয়ার জন্য যুবকদের চিন্তাকে আমি প্রশংসা করি। তাদের হাত দিয়ে এই দিনে দুজন প্রবীণ নারী তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছেন। এই ধরণের চিন্তা যদি দেশের সকল যুবকের মাথায় আসে তাহলে আমাদের দেশটা একদিন স্বপ্নপূরণের দেশ হবে।’
ভালোবাসাকে নানাভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আমাদের দেশের কবি সাহিত্যিকগণ। তাঁরা কেউ ছন্দের গাঁথুনি দিয়ে বা তুলির আঁচড়ে ভালোবাসার প্রকাশ করেছেন। কিন্ত এই বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে আমাদের তরুণ সমাজ যেভাবে তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছে তা একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে সকলের কাছে।