আগে আমাদের কেউ মূল্যায়ন করতেন না এখন করেন
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
২৭ এপ্রিল সকাল ১১টা। খবর সংগ্রহের জন্য সতীর্থ সাংবাদিক নূরুল ইসলাম মাস্টারকে সাথে নিয়ে যখন পাবনার চাটমোহরের গুনাইগাছা ইউনিয়নের পৈলানপুর গ্রামের মৃত শমসের প্রাং এর ছেলে আলেপ হোসেনের বাড়িতে পৌছি তখন শাবানা, নার্গিস, ববিতা, মনি, খুশী, সাথী, হাঁসি, লাবণী, শায়লা, কাজলী, মরিয়ম, পাখি, সোনিয়া, বৃষ্টি, মৌসুমী এমন মনোহরা নামের গাভীগুলো আয়েশ করে শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছিল। আলেপকে ডাকতেই বাড়ির মধ্য থেকে তার স্ত্রী শিল্পীয়ারা পারভীন বেরিয়ে এসে জানান, মাঠে ঘাস কাটতে গেছেন তার স্বামী। কিছুক্ষণের মধ্যে গাভীর খাবার ঘাস নিয়ে বাড়ি ফিরলে কথা হয় আলেপ ও শিল্পীয়ারার সাথে।
একটা গাভী থেকে পঞ্চাশটি গরুর মালিক হওয়া স্নাতোকোত্তর ডিগ্রীধারী উনচল্লিশ বছর বয়স্ক আলেপ তার সফলতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘২০০৭ সালে পাবনার এডওয়ার্ড বিশ^বিদ্যালয় কলেজ থেকে ইতিহাস বিষয়ে এম এ ডিগ্রী অর্জন করার পর বেসরকারি সংস্থা ব্রাক, সৌর বিদ্যুৎ বিপনন, ও গার্মেন্টস এ কিছুদিন কাজ করি। এর কোনটিই ভালো লাগে না। তখন বাড়ি ফিরে গরুর খামার করার স্বপ্ন দেখি। এমন সময় বাবা আমাদের পৃথক করে দেন।
পৈত্রিক সংসারের ভাগ বাটোয়ারায় আমি একটি দুগ্ধবতী গাভী পাই। তখন বাড়ি বাড়ি থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে মানুষের গাভীর দুধ কিনে ও আমার গাভীর দুধ ব্রাকের স্থানীয় চিলিং সেন্টারে বিক্রি শুরু করি। ভালোই লাভ হতে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এরপর ৮২ হাজার টাকা দিয়ে আরেকটি গাভী কিনি। এ গাভীটিও প্রতিদিন প্রায় ৩০ লিটার দুধ দিতে থাকে। এটি ২০০৯ সালের কথা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে গাভীর সংখ্যা। এঁড়ে বাছুরগুলো বড় করে বিক্রি করি আর বকনা বাছুরগুলো পালন করতে থাকি। দশ বছরের মাথায় আমার খামারে গাভী ও বাছুরের সংখ্যা ৫০ এ এসে দাঁড়ায়। এর মধ্যে কয়েকদিন পূর্বে সাতটিসহ এ পর্যন্ত অনেক ষাঁড়, গাভী বিক্রি করে প্রায় সাত বিঘা জমি কিনেছি। দশ বছর পূর্বে আমার একটা মাত্র টিনের ঘর ছিল। এখন তিন তলা ভিত দিয়ে চার রুমের ছাদওয়ালা বাড়ি করেছি। সব মিলিয়ে এখন আমি অনেক ভালো আছি।’
আলেপ হোসেন বলেন, ‘এর জন্য আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এখনো প্রতিদিন সকালে উঠে গরুগুলোর পরিচর্যা করি, দুইবার দুধ দোহন করি, গরুগুলোকে গোসল করাই, পানীয় পরিবেশন করি এবং আমাদের গ্রামে অবস্থিত ব্রাকের চিলিং সেন্টারে দুধ দিতে যাই। এখন আমি আমার গাভীগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২শ’ লিটার দুধ পাচ্ছি। এসব কাজে সহযোগিতার জন্য দুই জন মানুষ রাখা আছে। তারা ঘাস বোনা কাটাসহ অন্যান্য কাজে আমাকে সহায়তা করে। খাওয়া পরা ছাড়াও তাদের মাসে দশ হাজার টাকা করে বেতন দেই। বাড়িতে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করেছি। গমের ভূষি, ভুট্রার গুড়া, নাড়িকেলের খৈল সহ গরুর অন্যান্য খাদ্য বাবদ প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া অন্যান্য খরচ তো আছেই। এলাকার অনেক খামারী এখন আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসে।’ রোগ ব্যাধি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গাভীর ওলান ফোলা ও ক্ষুরা রোগ বেশি হয়। তবে বড় গাভীগুলোর শরীরের মধ্যে বোলাস ঢুকিয়ে দেয়া আছে। সূর্যমূখী প্রাণী সম্পদ কর্তৃপক্ষ ঢাকা থেকেই গাভীগুলো মনিটরিং করেন। যখন কোনটি কোন অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হতে যায় তখন তারা আমার মোবাইলে মেসেজ দেন। আমি ব্রাকের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। তারা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেন। খামারের কাজে আমার স্ত্রী সার্বক্ষণিকভাবে আমাকে সহায়তা করেন।’
আলেপের স্ত্রী শিল্পীয়ারা বলেন, ‘সাংসারিক কাজে সারাদিন বাড়িতেই থাকি আমি। বারবার গরুগুলো দেখাশুনা করি। এ ছাড়া যখন শ্রমিকেরা থাকে না তখন গরুগুলোর পরিচর্যা করি, ঘর পরিষ্কার করি, খাবার দেই, পানি দেই, কোন গরুর কোন সমস্যা হলো কিনা দেখি। আমাদের দুইটি মেয়ে। বড় মেয়ে আইরিন সুলতানা চাটমোহর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী আর ছোট মেয়ে সুমাইয়া আফরিন জান্নাতি’র বয়স ৩ বছর। সংক্ষেপে বলতে গেলে আমরা খুব ভালো আছি।’ হাস্যোচ্ছলে তিনি আরো বলেন, ‘আগে আমাদের কেউ মূল্যায়ন করতো এখন করেন।