প্রাণবৈচিত্র্য কথন
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
২২ মে ২০১৯ প্রাণবৈচিত্র্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য’। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে নেত্রকোনা শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির আযোজনে নেত্রকোনা জেলা প্রাশাসকের সম্মেলন কক্ষে উদযাপিত হল আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস ২০১৯। নেত্রকোনা শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির আহবায়ক প্রভাষক নাজমূল করিমের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় জেলা প্রশাসক মইনউল ইসলাম। অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মতিন্দ্র সরকার, জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বাবু শ্যামলেন্দু পাল প্রমূখ।
নেত্রকোনা শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সদস্য গণমাধ্যম কর্মী আল্পনা বেগমের সঞ্চালনায় দিবসটি উপলক্ষে প্রবন্ধ পাঠ করেন দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিসেস নাঈমা সুলতানা লিমন। প্রবন্ধে নেত্রকোনা অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্যের সেকাল ও একালের চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রবন্ধ পাঠ শেষে উন্নয়ন কর্মী অহিদুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয় প্রাণবৈচিত্র্য কথন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন জাতিস্বত্ত্বার কিশোর-কিশোরী ও যুবরা নেত্রকোনা অঞ্চলে নদী, বন, প্রাণী ও পেশাজীবীদের কথা সম্বলিত ফেস্টুন প্রদর্শন করেন এবং এগুলো রক্ষার দাবি জানায়।
প্রধান অতিথি মাননীয় জেলা প্রশাসক মইনউল ইসলাম বলেন, ‘প্রাণবৈচিত্র্যের উন্নয়নের সাথে সাথে প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পাশাপাশি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় ফসল, বৃক্ষ ও প্রাণীর জাত তৈরি হচ্ছে। সরকার এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসডিজি অর্জনে সকলকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। কোন বিভাগের ক্ষতি না করে সকল বিভাগের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে উন্নয়নে কাজ করতে হবে।’ তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যলয় প্রাঙ্গনে মেহগনি গাছের বাগান সম্পর্কে বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মেহগনি বাগান করা ঠিক হয়নি। মেহগনি গাছ বাউন্ডারিতে রোপণ করে মাঝখানে বৈচিত্র্যময় ফলের চারা রোপণ করা হলে অনেকেই এর ফল খেতে পারত, মানুষ না খেতে পেলেও পশু-পাখি খেতে পারত। বৈচিত্র্যময় পাখি এ বাগানে থাকত, অনত্র যেতনা।’ তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নেত্রকোনার পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের উনন্নয়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করার আহবান জানান।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকার বলেন,‘বর্তমান পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। বৈচিত্র্যময় পেশার মানুষ প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের উপর নির্ভরশীল। মানুষ প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে, ফলে এসবের পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত। উন্নয়নের সাথে সাথে পরিবর্তন অনিবার্য, তবে প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করে নয়। প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হবে সেটিও কাম্য নয়। তিনি স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি নতুন নতুন জাত আবিষ্কার করে সেগুলো সংরক্ষণের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
নাজমুল কবির সরকার বলেন,“সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন বৈচিত্র্য দিয়ে। পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণী পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। একটি প্রাণী অন্যপ্রাণীর উপর নির্ভরশীল। তাই প্রাণবৈচিত্র্য ঠিক থাকলে প্রকৃতি ও পরিবেশ যেমন ঠিক থাকবে, তেমনি অনেক সমস্যার সমাধান আপনা আপনি লাঘব হবে।
নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ এর সাধারণ সম্পাদক ও সমাজ সেবক সাইফুল্লাহ ইমরান তার বক্তব্যে বলেন, ‘নেত্রকোনা জেলা প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। এখানে যেমন নদী ও হাওর রয়েছে, তেমনি এসব নদী ও হাওরে রয়েছে হাজারো প্রাণের অস্তিত্ব। কিন্তু বর্তমানে নদী দখল, নদী ভরাট ও হাওরগুলোর পানি দূষিত হয়ে গেছে। ফলে প্রাণবৈচিত্র্য অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মূখীন। হারাঞ্চলের বিশুদ্ধ পানির ব্যাপক সংকট। পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি হওয়ায় মানুষসহ সকল প্রাণীকূল বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। প্রাণবৈচিত্র্য টিকে থাকার জন্য প্রযোজন বিশুদ্ধ পানির।’ বিশুদ্ধ পানির সমস্যা দূরীকরণে তিনি জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় সব ধরণের কাজে লোভ সংবরণ করে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যবান্ধব উপায়ে কাজ করার আহবান জানান।
নেত্রকোনা শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির উপদেষ্টা ও নেত্রকোনা জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বাবু শ্যামলেন্দু পাল তার বক্তব্যে আক্ষেপ করে বলেন, ‘নেত্রকোনা শহরের চারিদিক মগড়া নদী দিয়ে ঘেরা। এককালের খরস্রোতা মগড়া নদী আজ অবৈধ দখল ও শহরের মযলা অবর্জনা দ্বারা ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নদীর উপর নির্ভরশীল প্রাণীকূল, কৃষি আজ বিপর্যস্ত ও বিলুপ্তপ্রায়। মগড়া নদী ও এর সাথে সংযুক্ত খালগুলো দীর্ঘদিন যাবত খননের কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত তার বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
প্রাণবৈচিত্র্য পরিবেশ, প্রকৃতি ও সকল প্রাণীকূলের টিকে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিছুসংখ্যক লোভী মানুষের প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী কাজের জন্য আজ তা হুমকির মুখে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগে স্কুল পর্যায়ে ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বৃক্ষ রোপণ অভিযান করতে দেখা যেত, কিন্তু বর্তমান সময়ে বৃক্ষ রোপণের তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। নেত্রকোনা শহরে বন বিভাগের অফিস রয়েছে, কিন্তু এ বিভাগ কি কাজ করছে তা আমরা জানিনা। বন বিভাগ বৈচিত্র্যময় বৃক্ষ রোপণ করে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’ তিনি বন বিভাগসহ সকল সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রতি মৌসুমে বৈচিত্র্যময় বৃক্ষরোপনে নির্দেশ দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অনুরোধ জানান।
অনুষ্ঠান শেষে মাছের জাতবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বৈচিত্র্যময় কলা সংরক্ষণ, মধু চাষের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তাকারী ও জৈব চাষি, বৈচিত্র্যময় ধানের জাত সংরক্ষণকারী এবং বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও বিনামূল্যে বিতরণের মাধ্যমে বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করা হয়। দলিত সম্প্রদায়ের দু’জন কিশোরীকে তাদের সমাজের একজন কিশোরীর বাল্যবিবাহ বন্ধে অবদানের জন্য পুরষ্কৃত করা হয়। অনুষ্ঠানে দিবসটি উপলক্ষে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলিত সম্প্রদায়ের তিনজন কিশোরীকে পুরস্কৃত করা হয়।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী মৌচাষি গোলাম মোস্তফা মধু এবং বৈচিত্র্যময় ধানের জাত সংগ্রহকারী কৃষক সায়েদ আহম্মদ খান বাচ্চু অতিথিদেরকে মধু ও সুগন্ধি চাল উপহার প্রদান করেন।