মানুষ মানুষের জন্য
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
একমাত্র ঘরটাই সম্বল হত দরিদ্র প্রবীণ চিনি বালার। অসুস্থ স্বামী আর প্রতিবন্ধী এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। দুবেলা দুমুঠো অন্নের জন্য এই চিনিবালার নিরন্তর হাড়ভাঙা খাটুনী যেন ফুরাবার নয়। মানিকগঞ্জের বলড়া ইউনিয়নের বড়ইচড়া গ্রামের এই পরিবারটির একমাত্র আয়ের উৎস একটি দুধালো গাভি পালন। সেই গাভির দুধ বিক্রিই তাদের চাল-ডালের যোগান। হঠাৎ অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় একমাত্র ঘড় ও গরু। এরপর হয়ে যায় তারা খোলা আকাশের নিচের বাসিন্দা। যে দেখে সেই আফসোস করে, মায়ামাখা দু’চারটি কথা বলে চলে যায়। কিন্তু আসল কাজের কাজটি করলো এলাকার কয়েকজন তরুণ যুবক। ভোরবেলা হাজির চিনিবালার বাড়িতে। টিন, কাঠ, লোহা লস্কর আর মিস্ত্রিদের নিয়ে একদিনেই মেরামত করে দিল চিনিবালার ঘরটি। গরুটির চিকিৎসার জন্য প্রদান করে নগদ টাকা। সেদিন অঝড়ে কেঁদেছিল চিনিবালা। অসহায়ের প্রতি সহায়তা আর মহৎ কর্মদানের আনন্দে। আসমান পানে দুহাত তুলে তার প্রার্থনা ‘সৃষ্টিকর্তা তুমাগো অনেক ভালো করবো বাবা’। চিনিবালার মতো এমন শত অসহায়-দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘নবজাগরণ সমাজ কল্যাণ সংঘ’।
হ্যাঁ, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। মানুষের বিপদের সময় তার পাশে থেকে সহযোগিতা করাই মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে যদি একটি প্রাণ বাঁচে; একজন মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখে তাতেই হয়তো জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বিভিন্ন সময় আমাদের সমাজে কিংবা ব্যক্তি জীবনে দূর্যোগ নেমে আসে। তখন আমাদের সমাজের কিছু মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই তাদের প্রয়োজন হয় সহযোগিতার। মানুষের জন্যই তো মানুষ! সঙ্কটে, বিপদে মানুষই ছুটে এসে সাহায্য করবে এই প্রত্যাশা আমরা করতে পারি। না হলে মানবজন্ম অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের তরুণ সমাজ এখন অনেক বেশি সচেতন এই কাজে। তার বাস্তব উদাহরণ মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত ভাড়ারিয়া এলাকার এই ‘নবজাগরণ সমাজ কল্যাণ সংঘ’।
স্বপ্নবাজ এই তরুণদের একটাই লক্ষ্য সমাজের কোন মানুষ যেন অবহেলিত না থাকে। তাই তারা সমাজের বৈষম্য দূর করতে নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। কোন শিশু যাতে লেখাপড়ার সামগ্রীর অভাবে ছিটকে না পড়ে। সেজন্য তারা বিদ্যালয়ের ৩০ জন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ড্রেসের কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করেন। এছাড়াও আশেপাশের কয়েটি গ্রামে সরজমিন ঘুরে তারা খুঁজে বের করেন দরিদ্র -মেধাবী ১২ জন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যাদের পরিবার পড়াশোনার খরচ বহন করার অপারগতায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তাদের শিক্ষাজীবন। এই ১২ জন শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক পর্যন্ত যাবতীয় পড়াশোনার ব্যয় ভারের দায়িত্ব নেয় সংগঠনটি। দরিদ্র পরিবারের এক কলেজ ও একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করে সংগঠনটি। গত ঈদে ১১৫ জন নিম্ন আয়ের ও হত দরিদ্রদের বাড়ি গিয়ে বিতরণ করেন ঈদ পোশাক। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন সবাই। দূর্গা পূজায় কায়িক শ্রমিক ১৬ জন হিন্দু নারী পুরুষদের মাঝেও বিতরণ করেন নতুন পোশাক। নদী পাশ্ববর্তী এলাকায় শীতকালে তীব্র শীত অনুভূত হয়। যাদের শীত নিবারণের ভালো মানের কম্বল কিংবা তোষক ক্রয়ের ক্ষমতা নেই। সেইসব পরিবার খুঁজে একটি লিস্ট করেন সদস্যরা। সাড়ে ৩ শত শীতার্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করেন কম্বল। বিদূৎবিহীন একজন বয়স্ক মহিলাকে চার্জার লাইট প্রদান করে দিয়েছেন আলোক বর্তিকা। মুমুর্ষু রোগীদের চিকিৎসার জন্য নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান, সদস্যদের মধ্য থেকে রক্তদান। নিরীহ পরিবারকে দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য সহায়তা করা, কন্যা দায়গ্রস্ত পরিবারকে বিয়ের জন্য নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান, এলাকায় নবনির্মিত কবরস্থনে মাটি ভরাটের কাজে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মতো এমন অনেক মহৎ কাজ করে যাচ্ছে এই সংগঠনটি।
পোষাক কিংবা শীতবস্ত্র অথবা আর্থিক অনুদান, শিক্ষা উপকরণ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন সাহায্যপ্রাপ্ত এসব মানুষেরা। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে এই মানবীয় সহায়তা পেয়ে অনেকেই আনন্দে কেঁদে ফেলেন। সংগঠনের পক্ষ থেকে শিক্ষা ব্যয় বহন করা হাটিপাড়া ইউনিয়নের বধূটি গ্রামের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী ফারজানার মা মাজেদা বেগম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, মেয়েরে পড়ানোর মতো সাধ্য আমার নাই। মেয়ে আমার ভালো ছাত্রী। অর্থের অভাবে যখন মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার মতো। তখন ওই নবজাগরণ থেকে আমার মেয়ের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়। আমার মেয়ে এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। আমি অনেক খুশি। আল্লায় ওগোরে ভালো করবো।’
মহান মানব সেবার কাজে ব্রতী হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় নবজাগরণ সমাজ কল্যাণ সংঘ। ভালো কাজে শরিক হতে সদস্য সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজের যেখানেই সমস্যা তারা সেখানেই ছুটে যায়। কোন পরিবারে কি সমস্যা সেটি জেনে সেভাবেই তারা উদ্যোগ নেয়। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন পরম মমতায়। সংগঠনটির মূল কর্মসূচি হচ্ছে সমাজের অসহায় মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র বিতরণ করা, গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে শিক্ষা সহায়তা ও শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ, অস্বচ্ছল রোগীদের বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা, গণসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি আদর্শ ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। শুধু তাই নয়, প্রতিভা বিকাশে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদী এবং জাতীয় দিবসসমূহ পালন করা। চলতি বছরের ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ বীর প্রতীক মাহুফুজুর রহমানের নামে চালু করা হয় একটি গ্রন্থাগার।
ভালো কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপনে প্রয়োজনের মুহূর্তে সাধ্যমতো সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। হাতে হাত রেখে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছেন সদস্যরা। মানুষ মানুষের জন্য-জীবন জীবনের জন্য এই স্লোগানকে সামনে রেখে গঠন করা হয়েছে এই সংগঠন। তারই প্রমাণ রেখেছে সংস্থার সদস্যবৃন্দ।
সরজমিন গত বুধবার ভাড়ারিয়া বাজারে নবজাগরণ সমাজ কল্যাণ সংঘের কার্যালয়ে কথা হয় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শুভ্র সাহা, কোষাধক্ষ্য মোঃ সবুজ মিয়া, ক্রীড়া সম্পাদক মোঃ ইউসুফ আলী, প্রচার সম্পাদক রাহুল রাজ, সাংষ্কৃতিক সম্পাদক রনি বৈরাগী, সদস্য বিমল সাহা, কোরবান আলী, তানিয়া আক্তার ও জোনাকি আক্তারের সাথে। এরই মাঝে ফোন আসে সংগঠনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সৌদি প্রবাসী মো. ইমান আলীর। তারা জানালেন, বর্তমান কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২০ জন। মোট সদস্য সংখ্যা ৮৯ জন। সদস্যদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি প্রবাসী। সুদূর প্রবাসে থেকেও তারা এলাকার অসহায় আর দরিদ্র মানুষের সেবায় নিয়মিত পৌছে দিচ্ছেন তাদের কষ্টার্জিত অর্থ। প্রত্যেক সদস্য এসব উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের জন্য মাসিক অনুদান প্রদান করেন। এরপরের সামর্থ অনুযায়ী সদস্যরা প্রদান করেন বিভিন্ন অংকের অনুদান। সদস্যরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই কর্মব্যস্ততার মধ্যে সময় অতিবাহিত করলেও ভালো কাজে একে অপরকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে যেন আগামীর সম্ভাবনার পথকে প্রসারিত করতে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে সহায়তামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখছেন। প্রশংসা কুড়িয়েছেন সর্বমহলের। আগামী দিনগুলোতে একই সাথে মানব সেবায় সম্পৃক্ত থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সব সদস্য।
সংগঠনটির সভাপতি তরুণ ব্যবসায়ী মো. জয়নাল আবেদীন মোল্লা বলেন, ‘এই সমাজ পরিবর্তন করতে হলে মহৎ শক্তির প্রয়োজন। আমরা সবাই এক হলে সমাজে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা থাকবে না। একজনের বা সরকারের একার পক্ষে সবকিছু বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমরা আমাদের সাধ্যমত কাজ করছি। যাতে সমাজে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা না থাকে।’ এলাকার প্রবীণ সমাজ সেবক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোঃ আইয়ুব আলী মাস্টার ও মোঃ শফি উদ্দিন আহম্মেদ মাস্টার বলেন, ‘আমরা অনেকেই যা করতে পারিনি, এই তরুণরা তা করে দেখাচ্ছে। ওদের কাছ থেকে অনেকেরই শিক্ষা নেয়া উচিত। মানুষের বিপদের সময় তার পাশে থেকে সহযোগিতা করাই মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়াই জীবনের সার্থকতা। আর এই মহৎ কাজটি করে যাচ্ছে নবজাগরণ সমাজ কল্যাণ সংঘের সদস্যরা।