ঘূর্ণিঝড় বুলবুল: পানি নিয়েই যতো ভাবনা
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় যে দিকে তাকানো যায় শুধূ পানি আর পানি। কিন্তু এ পানি সব সুপেয় পানি নয়! সব পানিই ব্যবহার উপযোগী নয়। এখানে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা বাণিজ্য হয় লবণ পানি নিয়ে। এ নদীর লবণ পানি তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ। ঠিক এ পানি নিয়ে আবার সমুদ্র কূলবর্তী এলাকায় চিংড়ি ঘের করে নানান ধরনের মাছ চাষ হচ্ছে। এ মাছ চাষ শুরু হয় ১৯৬০ দশকের পর থেকে। আর যতই দিন যাচ্ছে ততই লবণ পানির চিংড়ি ঘের বিস্তার লাভ করছে। যার কারণে কৃষিজমি কমছে, কমছে প্রাণ, প্রকৃতি, কমছে সুপেয় পানির উৎস।
আমরা জানি, ভৌগলিক ও কৃষিপ্রতিবেশগত ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানি লোনা। এ এলাকার সুপেয় পানির উৎস খাল, ডোবা, নালা ও পুকুর। কিন্তু সমুদ্রকুলবর্তী হওয়াতে এখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েই থাকে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে মানব সৃষ্ট দুর্যোগ! প্রাকৃতিক ও মানব সুষ্ট দুর্যোগ একাকার হয়ে এখানকার মিষ্টি পানিকে লবণাক্ততায় রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া চলে আসছে। একটি এক ধরনের মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো উপকূল এলাকায় একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এসব দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ সম্পদের মধ্যে হলো সুপেয় পানি। উপকূল বিশেষ করে সাতক্ষীরা গত ১০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মহাতাণ্ডবে উপকূল এলাকায় বসতি ঘর, লেট্রিন, গাছ গাছালি, মৎস্য ঘের, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের সম্পদ (আসবাবপত্র, প্রাণী সম্পদ, শিক্ষা উপকরন, সবজী ও ধান বীজ) ধান ক্ষেত, সবজি ক্ষেত, বাড়ির আঙিনার বাগান তছনছ হয়েছে। এছাগা পুকুরের পাড় ধ্বস, রাস্তা ধ্বংস, ওয়াপদা রাস্তা ভাঙন, সুপেয় পানির পুকুর ও পিএসএফ নষ্টসহ ছোট বড় অনেক ধরনের ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কালিনগর গ্রামে মাঠ পর্যবেক্ষণ স্থানীয় জনগোষ্টীর কাছে তাদের সুপেয় পানির যে উৎসগুলো ছিলো তার অবস্থা এবং কি ধরনের সমস্যার সন্মূখিন হচ্ছে বর্তমানে তা জানার চেষ্টা করা হয়। সেক্ষেত্রে কালিনগর গ্রামের কাজল সরদার বলেন, ‘আমাদের এই গ্রামে সুপেয় পানির দুটি পুকুর আছে যার মধ্যে অনত্যম হলো আমাদের এ সরদার বাড়ির পুকুর, যার আয়তন দেড় বিঘা। পুকুরটি আমাদের পুর্বপুরুষদের হাতে কাটা পুকুর। পুকুরটিতে আমাদের গ্রামসহ আশেপাশের আরো ৬ গ্রামের মানুষ পানি খায়। এছাড়াও সুন্দরবন ও মালঞ্জ নদীর কাছে হওয়াতে সুন্দরবনের যতো জেলে, বাউয়ালিরা এই পথে যায় তারাও এখান থেকে পানি নিয়ে যায়। দিনে প্রায় ৫০০ পরিবারের বেশি মানুষ এখান থেকে পানি সংগ্রহ করে। পুকুরটির পানি খাওয়ার কাজে বেশি ব্যবহার করে বলে এখানে তেমন করে মাছ চাষ করা হয় না। মূলত আমরা বেঁচে আছি এ পানির উপর নির্ভর করে। তা না হলে আমাদেরকে প্রায় ৮ কিলোমিটিার দুর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হতো এবং অনেক দামে পানি কিনতে হতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে লবণ পানি প্লাবিত না হলেও অন্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আর তা হলো পুকুর পাড়ের গাছ পুকুরের মধ্যে পড়েছে, গাছের ডালপালা ও পাতা পড়েছে, বাইরের বর্জ্য পানি পুকুরের মধ্যে ঢুকেছে, পুকুরের পাড় ভেঙে গেছে, পিএসএফ এর টিন নেই এবং যে ফিল্টার তা ফেড়ে পানি পড়ছে। এতে করে পুকুরের পানির রং পরিবর্তন হতে শুরু করেছে, পুকুরের মাছগুলো খাবি খাচ্ছে, মাছ মরাও শুরু হয়েছে। পানি ভালো রাখার জন্য নিজেরা চুন, পটাশ ও ডালপালা উঠিয়ে দিয়েছি কিছুটা কমেছে। কিন্তু কতোদিন যে ভালো থাকবে তা বলা যাচ্ছে না। একদিকে পানির সমস্যা অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়বো কারণ পুকরে তেমনভাবে মাছ চাষ না করলেও এখান থেকে বছরে প্রায় ৬০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে পারতাম।’
পানি সংগ্রহ করতে আশা রুপা রানী, লিপিকা মন্ডল, দেবী রানী, ও জগদীশ সরদাররা জানান যে, পানির এখন যে অবস্থা দ্রæত পুকুর ভালোভাবে পরিস্কার করা দরকার তা না হলে পানি খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। পানির রং পরিবর্তন হয়েছে। তারা ফিল্টার থেকে পানি সংগ্রহ করছেন তারপরও পানিতে এক ধরনের গন্ধ ও নালাভাব দেখা দিয়েছে। তাঁরা তাঁদের সহায় সম্পদ নিয়ে খুব বেশি চিহ্নিত নন; তাদের ভাবনা হলো সুপেয় পানি। পানি যদি ভালো থাকে তাহলে তাঁরা সবাই ভালো থাকবেন বলে তারা জানান। এছাড়াও আমাদের গ্রামে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে কম বেশি পুকুর আছে যা দিয়ে মাছ চাষ ও গৃহস্থলির কাজে ব্যবহার করা হয়।
তারা বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে গ্রামের প্রায় প্রত্যেক বাড়ির গৃহস্থালি ও মাছ চাষের এ পুকুরগুলো গাছের পাতা ও গাছের ডাল পড়ে কম বেশি নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে করে আমাদের নানান ধরনের সমস্যার সন্মূখিন হতে হবে যেমন পানিবাহিত রোগ ও চর্ম রোগ হওয়ার সম্ভাবনা, গৃহস্থালির কাজে সমস্যা, মাছের ক্ষতি, দুরবর্তী এলাকাথে সুপেয় পানি সংগ্রহ এবং পানি ক্রয় করতে হবে।’