বস্তির ধলু মিয়া বাঁচতে চান

ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল

তাঁর নাম ধলু মিয়া (৬৫)। অবিভক্ত ফরিদপুর জেলায় মাদারীপুরের শিবচরের ভান্ডারিকান্তি গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা রতন ফকির ছিলেন একজন কৃষক। তার মা বনা বিবি ছিলেন খুবই সংসারী মানুষ। তাদের গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে পদ্মা নদী। ছোট্টবেলা থেকেই নদীর ভাঙ্গা গড়া দেখেই তাদের জীবন শুরু। চোখের সামনে কত ঘর বাড়ি, গাছপালা, সহায় সম্পদ হারিয়ে মানুষ নিঃস্ব হয়েছে রাতারাতি তার হিসাব নেই তার কাছে। বর্তমানে তিনি মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যোনের সোনা মিয়ার টেক বস্তিতে বসবাস করেন।

d 1
আজ এই বয়সে এসে সেই সকল কথা তার প্রায়ই মনে পড়ে। প্রকৃতির কোন ঠিক ঠিকানা নাই। আজ একরকম তো কাল আরেক রকম। তিনি তাঁর জীবনে অনেক ঝড় জলোচ্ছ¡াস দেখেলেন। দেখেছেন প্রকৃতির নিষ্ঠুর আচরণ। তবে নদী যেমন একদিকে ভাঙ্গে ঠিক আরেক দিকে গড়ে এটাই তার নিয়ম। আর মানুষকে সংগ্রাম করেই বাঁচতে হয়।

ধলু মিয়ার ৪ ভাই আর বাবা মাকে নিয়ে তাদের সংসার ছিল। সে পরিবারের বড় ছিলেন বিধায় বাবার সাথে সংসারের হাল তাকেই ধরতে হয়েছিল। তাই কোনদিন স্কুলের গন্ডিতে পা দেয়া হয়নি। যে কারণে টিপ সই দিয়েই তাঁকে চলতে হয়। এটা নিয়েও তার অনেক আফসোস।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিলো ১৬ বছর। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা থাকলেও তার শারীরিক গঠন দেখে তাকে নেয়া হয়নি। তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধাদের জন্য তথ্য আদান প্রদানের কাজ করতেন। তাঁর মা বনা বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করতেন আর তিনি তা পরিবেশন করে খাওয়াতেন। অনেক সময় পাক বাহিনীদের আগমনের খবর পৌছে দিতেন। এগুলো ভাবতেও তার ভালো লাগে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে এমন ভূমিকা পালন করলেও কোন সার্টিফিকেট নেননি।

dc2
মুক্তিযুদ্ধের পর পরিবারের প্রয়োজনেই তিনি ঢাকায় পাড়ি জমান। আর তখন থেকেই মোহাম্মদপুর অঞ্চলেই বসবাস শুরু করেন। ঢাকায় এসে দীর্ঘদিন রিকসা চালিয়েই সংসার চালিয়েছেন। তার তিন ভাইকে খাইয়ে পড়িয়ে বড় করেছেন। মাঝে ১৫/১৬ বছর মাছ ধরার কাজও করেছেন। ভাইয়েরা এখন সবাই যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত। এক ভাই ঢাকায় বাড়ি গাড়ি করেছেন কিন্তু এখন আর তার সাথে কোন সম্পর্ক রাখেন না। অন্য ভাইয়েরাও যার যার মত ব্যস্ত।
বস্তির জীবনে তিনি এখন খুবই অসহায় জীবনযাপন করছেন। বছর দুই আগে হঠাৎ করেই তার স্ট্রোক হয়। বর্তমানে বাম হাত, বাম পাসহ শরীরের বাম দিক অনেকাংশেই অক্ষম। তার জীবন সঙ্গীর আর ছোট ছেলে মুন্নার আয়ের উপর তাদের সংসার নির্ভরশীল। তার স্ত্রী জানান, মাসে প্রায় ৫/৬ হাজার টাকার ঔষধ লাগে তার। অভাবের এই সংসারে তার চিকিৎসাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ছ্টো ছেলে মুন্না বেশ ভালো ছাত্র ছিল কিন্তু এ পরিস্থিতির কারণে সে এখন মুরগি ফেরি করে বেড়ায়। দিনে ২০০ টাকা তার আয়। আর সে একটা হোটেলে রাধুনির কাজ করেন।

ধলু মিয়ার আজ বার্ধক্যের কড়াল আঘাতে জর্জরিত। বারসিকের পক্ষ থেকে সমাজসেবা কার্যালয়ে তার ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সমাজসেবা অফিসার তার নামটি লিপিবদ্ধ করেন। তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ্ইতোমধ্যে জমা দেয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, তিনি আগামীবছর থেকে বয়স্ক ভাতা পাবেন। এতো একজন ধলু মিয়ার কথা আমরা জানতে পারলাম কিন্তু পাইওনিয়র হাউজিং বস্তিতে এমন আরো অনেক ধলু মিয়ারা ধুকে ধুকে বেঁচে আছেন। কেউ কেউ বিনা চিকিৎসায় অযত্নে মারাও যাচ্ছেন।

ধলু মিয়া চান তাঁর মতো এমন বার্ধক্যের কড়াল গ্রাসে যারা জর্জরিত তারা যেন সরকারের এই সেবা পেতে পারেন। কাউকে যেন ধুকে ধুকে মরতে না হয়। আর তার সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা যাতে হয়। কারণ তিনি মনে করেন এই দেশের জন্য তিনিও তার সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আর আজ দেশের ও দায় আছে তার জন্য, তাদের জন্য কিছু করার।

happy wheels 2

Comments