বীজ সংরক্ষণে ও জৈব উপায়ে চাষাবাদে অভিজ্ঞ কৃষক আলামিন মিয়া
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
কৃষি, কৃষক ও বীজ এই তিনটির মধ্যে রয়েছে নিবিড় সর্ম্পক। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরণের সবজি, শস্য ও ধান চাষ করে আসছে। শুরু থেকে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও চাষাবাদের চর্চার মাধ্যমে মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা, ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জীবিকা র্নিবাহ করে আসছে এবং পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপুর্ণ ভ’মিকা পালন করে আসছে তা অস্বীকার করার অবকাশ নেই।
ষাটের দশকের শুরুতে সবুজ বিপ্লবের নামে আধুনিক কৃষির পত্তনের পর থেকে দেশের সকল কৃষক প্রথমে উচ্চ ফলনশীল এবং বর্তমানে হাইব্রিড জাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কৃষকরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফসল চাষ করতে গিয়ে রাসায়নিক সার, বিষ ও অন্যান্য আধুনিক কৃষি উপকরণের জন্য বাজার ও কোম্পানিনির্ভর হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ কৃষকরা বাজারের নির্ভর করে এখন কোন শস্য ফসলের বীজ সংরক্ষণ করেনা। মৌসুম শুরু হলে তারা বাজার থেকে বীজ কিনে জমিতে চাষ করছে। বাজারের বীজ ও কৃষি উপকরণের উপর নির্ভর করায় কৃষকরা এসব উপকরণ কিনে বেশ প্রতারিতও হচ্ছে।
বারসিক কৃষকদেরকে কৃষি উপকরণের জন্য বাজারের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ নিজেদের উৎপাদন ও সংরক্ষণের জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছে। কৃষকদেরকে এলাকাভিত্তিক বীজঘর স্থাপন করে সেখানে বীজ সংরক্ষণ করার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছে, যাতে কৃষকরা সময়মত তাদের প্রয়োজনীয় বীজ বীজঘর থেকে নিয়ে সঠিক সময়ে চাষ করতে পারে। বারসিক’র প্রচারণা ও পরামর্শের ফল স্বরূপ অনেক এলাকার কৃষকরা তাদের প্রয়োজনীয় বীজ নিজেরা সংরক্ষণ করছেন এবং অনেকে আবার কমিউিনিটিভিত্তিক বীজঘরে সংরক্ষণ করছে।
বর্তমান সময়ে বাজার থেকে উচ্চ মূল্যে উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের বীজ প্রতারিত হচ্ছে এবং হাইব্রিড বীজ দিয়ে চাষাবাদ করে উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম লাভবান হচ্ছে, সেখানে গ্রামেরই বেশকিছু কৃষক স্থানীয় জাতের ও উচ্চ ফলনশীল (ঐণঠ) জাত নিজস্ব জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে চাষাবাদ করে বেশ লাভবান হচ্ছে। কৃষি উপকরণের মালিকানা এখন যখন কোম্পানি তথা বাজারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় কৃষকরা হাহাকার করছে এমন সংকটেও নেত্রকোনা জেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের নগুয়া গ্রামের কৃষক মো. আলামিন মিয়া নিশ্চিন্ত মনে বহাল তবিয়তে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করে লাভবান হয়েছেন। কৃষক পিতা মো. মুজিবুর রহমান ও মাতা নমিতা আক্তার এর জ্যৈষ্ঠ সন্তান আলামিন মিয়ার দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর আর লেখাপড়া হয়নি।
পিতামাতা, ভাইবোন এবং স্ত্রী ও সন্তানসহ পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ৮ জন। চাষযোগ্য মোট জমির পরিমাণ ১০ কাঠ বা এক একর। আলামিন এর মূল পেশা হল কৃষি। তিনি শুধুমাত্র বৈচিত্র্যময় ধান ও সবজিই চাষ করেন না, চাষকৃত ধান ও সবজির বীজও নিজেই সংরক্ষণ করেন। চাষাবাদ ও বীজ সংরক্ষণে তিনি খুবই অভিজ্ঞ ও পারদর্শী। তিনি বীজ সংরক্ষণের বিষয়ে এলাকার একজন সম্পদ ব্যক্তি। প্রতিবছর চাষকৃত সকল ফসল কাটার আগেই তিনি বীজের জন্য ফসল নির্বাচন করে রাখেন। ফসল তোলার সময় হলে নির্বাচিত ফসলগুলো আলাদা করে সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বীজগুলো শুকিয়ে পরবর্তী মৌসুমের জন্য নিজস্ব পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে রাখেন। তথ্য সংগ্রহকালীন সময় পর্যন্ত তার সংরক্ষণে রয়েছে মোট ২৪ জাতের সবজি, মসলা, ধান ও তেল জাতীয় ফসলের বীজ, যার মধ্যে সবজি ৯ জাতের (শীতলাউ, মিষ্টিকুমড়া, জাম আলু, গোল আলু, করলা, বরবটি, শসা, চালকুমড়া ও সীম), এক জাতের ডাল ফসল (মাস কলাই), এক জাতের তেল ফসল (সরিষা), ৬টি স্থানীয় জাতের ধান (চিনিশাইল, সুবাস, মালশিরা, ব্রি-২৯, ব্রি-৩৯ ও কালোজিরা) এবং ৭ জাতের মসলা ফসল (আদা, হলুদ, বালিঝুরি মরিচ, কালোমরিচ, উর্বদা মরিচ, রসুন ও পেয়াজ) বীজ। আলামিন মিয়া এসব ফসলের বীজ পরবর্তী মৌসুমে নিজে চাষের জন্য ও বাজারে বিক্রির জন্য সংরক্ষণ করে থাকেন।
তিনি অন্যদেরকেও বীজ সংরক্ষণের জন্য উৎসাহিত করেন এবং বীজ সংরক্ষণে কারিগরি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে থাকেন। নিজ গ্রামের বাইরে অন্য গ্রামে গিয়েও তিনি কৃষকদের বীজ সংরক্ষণের জন্য পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। অন্য গ্রামে তিনি তার নিজের সংরক্ষিত বীজ নিয়ে যান এবং প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণার্থী কৃষক-কৃষাণী ও যুবদের মধ্যে বিতরণ করেন। এলাকার কৃষকদের মধ্যে তিনি সাধ্যমত ধান, সবজি এবং শস্য বীজ দিয়ে বিতরণ ও বিনিময় করেন। তিনি প্রায় ৫ বছর যাবৎ বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে আসছেন। গ্রামের অন্য কৃষকরা যেখানে প্রত্যেক মৌসুমে বাজার থেকে উচ্চ মূল্যে বীজ ক্রয় করে, সেখানে আলামিন বাজারের উপর নির্ভর না করে নিজের সংরক্ষিত বীজ দিয়ে চাষাবাদ করেন। বাজার থেকে কিনতে হয়না বলে তার ফসল উৎপাদন খরচও কম হয় এবং লাভ হয় ভালো। তিনি স্বপ্ন দেখেন কৃষকরা বাজারের বীজ কিনে মানসম্মত বীজ পেতে হয়রানি হচ্ছে না। নিজের সংরক্ষিত বীজ দিয়ে নিশ্চিন্তে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের চাষ করছে। তিনি কৃষি বীজ ও কৃষি উপকরণে কৃষকদের অধিকার ও মালিকানা প্রতিষ্ঠায় যথা সম্ভব এলাকার কৃষকদের সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করবেন বলে জানান।
আলামিন মিয়া ৫টি গরু আছে সে গরু গোবর দিয়ে ভার্মি কমপোস্ট উৎপাদন করে সবজি চাষ করেন। সবজি চাষে তিনি কোন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন না। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত উপায়ে সবজি চাষ করায় স্থানীয় পাইকার ও ভোক্তাদের নিকট তার উৎপাদিত সবজি কদর অনেক। তাকে বাজারে গিয়ে সবজি বিক্রি করতে হয় না, পাইকাররা বাড়ি এসে সবজি ও অন্যান্য ফসল কিনে নিয়ে যায়। এলাকার নবীন ও প্রবীণ সকল শ্রেণীর কৃষক-কৃষাণীরা ফসল চাষাবাদ ও বীজ সংরক্ষণে আলামিন বুদ্ধি ও পরামর্শ নেয়।
কৃষক আলামিন আশুজিয়া কৃষক সংগঠনের অন্যতম সদস্য। কৃষক আলামিন মিয়া সারা বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি ও অন্যান্য ফসল চাষ করে পরিবারের খরচ নির্বাহ করায় সংগঠনের সকল সদস্যরা আলামিন মিয়ার বাড়িটিকে শতবাড়ির অধীনে পুষ্টিবাড়ি হিসাবে নির্বাচন করেছে। আলামনি মিয়া এক জন দক্ষ কৃষককৃষক আলামিন ধান ও সবজি চাষে কোনে রাসায়নিক ব্যবহার না করে শুধুমাত্র গোবর ও কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে চাষাবাদ করে ফসল উৎপদন খরচ অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। তার ফসল উৎপাদন কৌশল গ্রামের অন্য কৃষকের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।
তিনি জৈব বালইনাশক তৈরি করে ধান, পাট, গম ও সবজিসহ সকল মাঠ ফসলে প্রয়োগ করেন। তিনি ২০ ধরণের জৈব বালাইনাশক তৈরি করে ব্যবহার করেন। সবজি ফসলের মাছি পোকা, বিটল পোকা, বিছা পোকা ও জাব পোকা দমনের জন্য তিনি নিমপাতা, আতা গাছের পাতা, তামাকপাতার নির্যাস দিয়ে, গোমূত্র, মরিচের গুড়া, কেরোসিন ও সাবানের গুড়া মিশ্রিত পানি, ছাই এবং কেরোসিন মিশ্রণ তৈরি করে বালাই দমনে ব্যবহার করেন।