মানুষের জন্য কিছু করার চেয়ে আনন্দ আর কিছু নেই
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে যারা শুধু নিজের জন্য ভাবেনা, যারা মানুষের জন্য কোন বিনিময় ছাড়াই কিছু করতে চায়। সেই সাধারণ পরিবারের অসাধারণ মানুষগুলোর মধ্যে একজন নেত্রকোনা জেলা আমতলা ইউনিয়নের গাছগড়িয়া গ্রামের খাইরুল ইসলাম। পেশায় একজন ভেটেরিনারি ।
বাংলাদেশে গ্রামের খুব সাধারণ পরিবারের ‘সম্পদ’ বলতে তাদের অনেক যতেœ পালন করা গরু বা ছাগল। দিনের পর দিন পরিশ্রম করে কৃষক কৃষাণী গরু, ছাগল পালন করে যা পরিবারের আয়ের একটি বড় অংশ হিসেবে উঠে আসে বছর শেষে। আর সেই গরু বা ছাগল যখন কোন ধরনের রোগে মারা যায় তখন পরিবারগুলো একটু একটু করে গড়া স্বপ্নগুলো ভেঙে যায়।
এ সম্পর্কে খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘একজন অতি দরিদ্র পরিবারের সত্তর থেকে আশি হাজার টাকা দামে গরু যখন মারা যায় তখন সে পরিবারের মানুষগুলো যে কষ্ট পায় তা না দেখলে কেউ বুঝবে না, আমি এমন অনেক মানুষকে দেখেছি মানুষের মৃত্যুর চেয়ে বেশি কান্না করছে গরু মরে যাওয়ার পর।’ সাধারণ মানুষের কষ্ট খাইরুল ইসলাম এ কাজে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। খুব কম সময়ে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালন ও চিকিৎসায় দক্ষ হয়ে উঠে। প্রতিষ্ঠানিকভাবে দক্ষতা বলতে যুব উন্নয়ন থেকে প্রাণী চিকিৎসা বিষয়ে ৩ মাসে প্রশিক্ষণ লাভ।
সাধারণ মানুষের সেবা
খাইরুল ইসলামের এ কাজ আমতলা ইউনিয়নের মানুষে সব চেয়ে বেশি কাজে আসে যখন করোনার কারণে গত বছর নেত্রকোনা সদর বা অন্যান্য ইউনিয়নে যোগাযোগ বন্ধ হয়। গত বছর করোনায় সময় গরুর এক ধরনের লামিপ স্কিন রোগে আক্রমণ করে। এতে করে গরু জ্বরে আক্রান্ত হয়, নাম মুখ দিয়ে লালা বের হয়, পা ফুলে যায়, দুই পায়ে পানি জমে যায়, শরীরে লোম উটে যায়। এ রোগে অনেক গ্রামে গরু মারা যাচ্ছিল। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যাতায়াত বন্ধ থাকায় চিকিৎসার জন্য নেত্রকোনা সদরে পশু হাসপাতালে যেতে পারছিলেন গ্রামের লোকজন। খাইরুল ইসলাম সে সময় নেত্রকোনা সদরের প্রাণী চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ করে রোগের প্রকৃত কারণ যেন প্রায় পাঁচশতাধিক গরুর চিকিৎসা করে যা আমতলা ইউনিয়নের মানুষগুলোর পাশাপাশি এদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রেখেছে।
রাস্তা তৈরি
প্রাণী চিকিৎসা করে থেকে শুরু কওে খাইরুল ইসলাম গ্রামের প্রতিটি সামাজিক কাজে ছুটে যান। গত বছর নিজের ১০ শতাংশ জমির এক একাঅংশ দিয়ে দেন গ্রামের খুব দরিদ্র কিছু পরিবারের পায়ে হাটার মাটির রাস্তা তৈরীর জন্য। চলতি বছর নিজে উদ্যোগে এক কিলোমিটার মাটির রাস্তা মেরামত করলেন গ্রামের মানুষকে নিয়ে এতে প্রায় দুইশতাধিক মানুষ গ্রাম থেকে সহযে পাকা রাস্তায় হেটে বা রিক্সায় আসতে পারবে।
আদর্শ কৃষক
নিজের বাড়িতে চার পাশে নানা ধরনের ফলজ গাছ রোপণ করেছে তিনি। পুকুর পাড়ে কয়েক ধরনের কলার গাছ লাগিয়ে তৈরি করেছে কলার বাগান। মৌসুম অনুযায়ী সবজি চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করেও প্রতিবেশিদের মাঝে বিতরণ করে। তিনি প্রতিবছর বাড়িতে নতুন নতুন গাছ লাগাতে পছন্দ করেন। যেখানে ভালো কোন জাতের ফলের গাছের সন্ধান পান নিয়ে আসেন। বাড়ির চার পাশে কোন জায়গায় ফাঁকা রাখেন না তিনি। তার এ ধরনের কাজে অনেক মানুষ উৎসাহিত করেছে, সবজি ও স্থানীয় জাতের ফলজ গাছ রোপণে যা এলাকার পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে।
প্রাণীসম্পদ পালন
গৃহপালীত প্রাণী পালনে সব সময় আগ্রহ ছিল তার। তিনি সারাবছর বাড়িতে ৩ ধরনে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালন কওে, যা পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে বাজারে বিক্রয় করতে পারে।
মাচ চাষ
খাইরুল ইসলাম গ্রামের আগ্রহী মাছ চাষীদের নিয়ে নিচু পতিত জমিতে নিজের উদ্যোগে মাচ চাষ শুরু করেন দুই বছর আগে। মাছ ধরা, পরিচর্যা সকল কাজে নিজে জড়িত থাকেন তাই গ্রামের সাধারন মানুষগুলোর খুব কাছের ও আপনজন খাইরুল কবির। প্রতিবছর খাবার চাহিদা পুরণ করে আশি, নব্বই হাজার টাকার মাচ বিক্রয় করেন, যার গ্রামের সাধারন কৃষকদের নিচু জমিতে মাছ চাষের আগ্রহ বাড়ছে। এখন গ্রামের অনেক অনাবাদি নিচু জমিতে মাছ চাষ শুরু করেছে।
সামাজিক সংগঠক
খাইরুল ইসলাম গ্রামের সাধারণ মানুষকে পরিবেশ, কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে আগ্রহ সৃষ্টিতে তৈরি করেছেন গাছগড়িয়া কৃষক সংগঠন। প্রতিবছর সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামে বৃক্ষরোপণ, জৈবকৃষির চর্চা বৃদ্ধি, স্থানীয় জাতের ফসল চাষ, মাছ চাষ ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চার উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন, সংগঠনের সহযোগি সংস্থা হিসেবে কাজ করছে বারসিক’র সাথে।
খাইরুল ইসলামের এ ধরনের ছোট ছোট কাজগুলো হয়তো মানুষে চোখে নাও পড়তে পারে, কারণ আমাদের সমাজে এ ধরনের অনেক মানুষ আছে যারা কোন লাভ-লোকসানের হিসেব না করে পথ চলে। আমরা চায় তাদের এ পথ চলা যেন কখনো থেমে না যায়। এ পথ ধরে তৈরি হোক নতুন খাইরুল ইসলাম।