বর্ষার সাথে আমাদের স্বপ্ন জড়িত
সাতক্ষীরা, শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
‘আমাদের বাড়ির চারপাশে পানি আর পানি। কিন্তু সব পানি ব্যবহার উপযোগী নয়। এখানে আছে শুধু লবণ পানি। একদিকে চুনা নদী অন্য দিকগুলোতে লবণ পানির চিংড়ি ঘের। আর এই লবণ পানির সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে আমাদের টিকে থাকতে হয়। আমাদের পারিবারিক সব কাজে এ পানি ব্যবহার করতে হয়। শুধুমাত্র খাবার পানিটা বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের বসতভিটাগুলোতে সব সময় ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু বর্ষাকালে মিষ্টি এলাকার মতো সব রকমের ফসল চাষবাদ করা যায়। এই সময়টা আমরা কেউ বসতভিটার কোন স্থান ফাঁকা রাখিনা। কারণ এসময় বৃষ্টি হলে ঘের, পুকুর ও নদীর পানিতে লবণের মাত্রা অনেক কম থাকে। তাই তো বর্ষার আগে থেকে আমরা ফসল চাষের জন্য সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। বর্ষা শুরু হলে বসতভিটায় নানা ধরনের ফসল চাষাবাদ শুরু করি। বর্ষার পাশাপাশি শীত মৌসুমেও কিছু সবজি চাষ হয়। বর্ষার সময় আমাদের বাড়িগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করি যা দিয়ে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণসহ ফসল বিক্রি করে কিছুটা আর্থিক লাভবান হতে পারি। যা দিয়ে পরিবারের বিভিন্ন সম্পদ ক্রয় করি। তাই তো বর্ষার সাথে আমাদের স্বপ্ন জড়িত।’
উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন শ্যামনগর উপজেলা ইশ^রীপুর ইউনিয়নের গুমানতলী গ্রামের কৃষাণী মর্জিনা বেগম। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সারাবছর তাকিয়ে থাকি বর্ষার জন্য। বর্ষা হলেই আমাদের সব রকমের ফসল চাষাবাদ শুরু করি। বর্ষার সময় আমাদের মিষ্টি পানির কোন সমস্যা থাকে না। আমাদের খাবার পানির সমস্যাও থাকে না। অন্যসময় তো দূর দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করে আনতে হতো। বর্ষার সময় আমাদের নানান ধরনের সুবিধা হয়ে থাকে। এসময় আমাদের কষ্ট কম হয়। এই সময়ে আমরা বাড়িতে চাষ করা সবজি খেতে পারি।’
মর্জিনা বেগম জানান, ‘শুধূ মাত্র বর্ষা ও শীত মৌসুমের যে সবজি ফসল হয় তা তাতেই পরিবারের আয়ের একটি পথ তৈরি হয়। এ থেকে যেমন সংসারের খাদ্য চাহিদা পূরণ আবার সবজি বিক্রি করে অন্য খাদ্যের চাহিদাও মিটাতে পারি। অনেক সময় আমরা অর্থের কারণে হাঁস-মুরগি ক্রয় করতে পারিন না। এসময় সবজি বিক্রি করে অনেক পরিবার হাঁস-মুরগি- ছাগল, বাড়িতে ফলজ গাছ ক্রয় করতে পারেন।’ মর্জিনা বেগম গত বছর সবজি বিক্রির টাকা থেকে ৪টি রাজ হাঁস, ৪টি মুরগি ও সংসারের প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী ক্রয় করেছেন। এখন তিনি বাড়িতে সবজি চাষের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি পালন করছেন, যা দিয়ে যেমন পুষ্টি চাহিদা পূরণ হচ্ছে তেমনি আর্থিক লাভবান হচ্ছে।’
মর্জিনা বেগম আরো বলেন, ‘আমরা বাড়িটি বারসিক সহায়তায় একটি শতবাড়ি তৈরি করেছি। আমার মোট ১৫ শতক জায়গা যার মধ্যে ঘরবাড়ি ও পুকুর রয়েছে। সেখানে আমি বর্ষা ও শীত মৌসুমরে বিভিন্ন সবজি চাষ করি।
এবছর বর্ষা মৈৗসুমে আমি বাড়িতে বেগুন, চালকুমড়া, ঢেড়স, শসা, পেপে, মিষ্টিকুমড়া, কলমিশাক, পুইশাক, মেনকা লাগিয়েছি। একটা সময় আমি বাড়িতে সেভাবে সবজি চাষ করতাম না। কারণ লবণ পানিতে ভালো হতো না।’ তিনি বলেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ২০ বছর আগে। বিয়ের পরে কয়েক বছর সবজী লাগানোর চেষ্টা করেছিলাম লবণের কারণে সবজি করতে পারতাম না। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে আমি ও আমার গ্রামের অনেকইে বর্ষা মৌসুমের সবজি চাষ করি। আর এটা সম্ভব হয়েছে এখান থেকে কয়েক বছর আগে পাশের জাওয়াখালী গ্রামের বারসিক এর উদ্যোগে সবজি চাষ ও বীজ সংরক্ষণ বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। সেখানে গাবুরা-বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের নারীরা প্রায় সরাসরি নদীর লবণ পানির পাশে সবজি চাষ করে সফল হয়েছেন। তাদের কথা শুনে আমরা আগ্রহ বেড়ে যায়। আর সেখান থেকে প্রতিবছ্র কম-বেশি আমিসহ আমার এলাকায় অনেকে সবজি চাষ করছেন এবং সফল হচ্ছেন। শুধুমাত্র মিষ্টি পানি হলে আমরা অনেক কিছু করতে পারতাম। আমাদের পানি ভালো হলে আমাদের খাদ্যেও সমস্যা হতো না।’
মিষ্টি পানির জন্য উপকূলীয় এলাকার সব স্থানে ফসল চাষ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। কিন্তু বর্ষা মৌসুমের খাল-পুকুর ও চিংড়ি ঘেরের পানিতে লবণের মাত্রা কম থাকায় সকলেই তাদের বসতভিটায় সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। তেমনিভাবে লবণের মধ্যে থেকে নিজস্ব জ্ঞান-দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিরন্তর চেষ্টা করছেন মর্জিনা বেগম। তার এ জ্ঞান-দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা সম্প্রসারণ হোক এবং অন্যদের প্রেরণা হোক এটাই আমাদের চাওয়া।