প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় জনসংলাপ
নেত্রকোনা থেকে মো: আলমগীর ও খাদিজা আক্তার:
মানুষের টিকে থাকার জন্যেই প্রাণী, উদ্ভিদ, জল, বায়ু, মাটি। তাই টিকে থাকার জন্যেই মানুষের উচিত তাদের প্রকৃতিকে সচল রাখা। মূলত প্রত্যেকটি সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিবেশ, সমাজ সংস্কৃতি বৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। সামাজিক এ বৈচিত্র্যে জন্ম হয়েছে ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থেকে। ভূ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্ম হয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য থেকে। তাই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ছাড়া মানুষের টিকে থাকা কঠিন। এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে নেত্রকোনার মানুষকে এগিয়ে আসতে। প্রকৃতির বৈচিত্র্যহীনতাই আমাদের বৈচিত্র্যহীনতার জন্যেই দায়ী। তাই সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে তার বৈচিত্র্যে ঘেরা প্রকৃতিকে। এর জন্যে সকলের সম্মেলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তাই জীবনের বৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে হলে প্রকৃতি মায়ের বৈচিত্র্য রক্ষায় নেত্রকোনার সকল মানব সন্তানকে এখনই উদ্যেগী হতে হবে। আমাদের নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর, জলাশয়, পাহাড়, বন, প্রাণী, গাছ, লতা, পাতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে নিশ্চিত করে নিশ্চিত করি আমাদের জীবন ও জীবিকা। কৃষক, জেলে, কুমার, কামার, কবিরাজ, আদিবাসী এবং হাওরপাড়ের মানুষ মিলে রক্ষা করবো আমাদের প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। রক্ষা করবো আমাদের সম্পর্ক, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। জাগিয়ে তুলবো আমাদের শ্রদ্ধাবোধ।
তাই গত ২১ মে, রোজ সোমবার ‘জাগাও বৈচিত্র্য, থামাও উষ্ণতা, বাঁচাও প্রাণ’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সপ্তাহ ২১- ২৭ মে পালন উপলক্ষ্যে বারসিক রামেশ্বরপুর রিসোর্স সেন্টার, সম্মিলিত যুব সমাজ, শিক্ষা সংস্কৃতি রক্ষা কমিটি, সমকাল সুহৃদ সমাবেশ, নেত্রকোনা উচ্চ বিদ্যালয় এর সবুজ ক্যাম্পাসে ২২ মে আয়োজন করে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে জনসংলাপ। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক প্রাবন্ধিক অধ্যাপক মতীন্দ্র চন্দ্র সরকার। বিশেষ অতিথি ছিলেন নেত্রকোনা সদর উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জনাব ফায়জুল ইসলাম। আলোচক হিসেবে ছিলেন সমকাল সুহৃদ সমাবেশের সভাপতি তপন সাহা, সাংবাদিক খলিলুর রহমান শেখ ইকবাল, বৃক্ষপ্রেমিক কবিরাজ আ: হামিদ, প্রধান শিক্ষক মজিবুর রহমান, এ্যাড: তপতী শর্ম্মা। উপস্থিত ছিলেন কৃষক, যুবক, জেলে, কৃষানি, পাখি সংরক্ষণকারী, কবিরাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক, শিক্ষার্থীসহ প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে ও পরিবেশ বান্ধব সুহৃদ উদ্যোগী মানুষগণ। সভাপতির দায়িত্বপালন করেন নেত্রকোনা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সবুজ মনের মানুষ জনাব নুরুজ্জামান। বক্তারা বলেন, প্রকৃতির প্রতি অত্যাচার অবিচারের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে নদী, নালা, খাল বিল, হাওর, জলাশয়, গাছ, মাছ, ধান, শস্যবীজ ফল, ফুল, লতা, পাতা, শালুক, শামুক, ব্যাঙ, পাখি, প্রাকৃতিক বন, পাহাড়, আবারো ফিরিয়ে আনতে চাই, আমাদের শস্য ফসলের জাতবৈচিত্র্য লতাপাতা ফুল, ফল মাছ সবই। গড়ে তুলতে চাই প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি আলোকিত সমাজ। গ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায় সকল স্তরে সকল মানুষের ভেতর প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে আরো বেশি দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল হওয়ার আহবান জানাই সবাইকে। কবিরাজ আ: হামিদ সকলকে ঘৃতকুমারি গাছ উপহার দিয়ে স্বাগত জানান। তিনি ঘোষণা করেন যে, আমি ৫০ হাজার ঘৃতকুমারি
গাছ শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করতে চাই। তাছাড়া নবীন ও প্রবীণের জলবায়ু ভাবনা, ১০ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের গাছ চেনা অনুষ্ঠান, প্রকৃতির পাঠশালায় আবহাওয়ার পরিবর্তন ও প্রাণবৈচিত্র্য সংকট বিষয়ক আলোচনা, ভিডিও প্রদর্শন, নদী বাঁচাই কৃষি বাঁচাই, প্রাণবৈচিত্র্য বাঁচাই ও পথ নাটক দিয়ে বিরামপুর উচ্চবিদ্যালয় ও লক্ষীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান, কৃষিবাড়ী ও সবুজ ক্যাম্পাস পরিদর্শন তৈরী, পাখি বাড়ী দেখা, জলবায়ু পরিবর্তন ও হাওরের জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন বিষয়ে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
আমাদের প্রয়োজনেই আমাদের নেত্রকোনার প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ, প্রাণসম্পদ, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর রক্ষা করা প্রযোজন। প্রকৃতি থেকেই মানুষ শিখেছে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক অতি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের স্পর্শে প্রকৃতি আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানুষ সেজেছে নব নব রুপে। টিকে থাকার সংগ্রাম উভয়কেই করেছে বৈচিত্র্যময়। কারণ বৈচিত্র্যতাই সুন্দর, বৈচিত্র্যতাই সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্যতাই উন্নয়ন।
আটপাড়া উপজেলার রামেশ্বরপুর গ্রামের তুষাইপাড়ের কৃষক সংগঠন কৃষক সায়েদ আহমেদ খান বাচ্চুর পরিচালনায় এবং অন্যান্য সদস্যদের আগ্রহে দেশ- বিদেশ থেকে সংগ্রহ করেন ৫০০ জাতের ধানবীজ বৈচিত্র্য। যা চাষের মাধ্যমে তিনি একালাকা উপযোগি জাত বাছাই ও সম্প্রসারণ করে যাচ্ছেন। ত্রিমোহনীর আ: হামিদ, বিচিপাড়ার আ. রশিদ, মঙ্গলসিদ্ধ গ্রামের যুব সংগঠন, নোয়াদিয়া গ্রামের ধান-শালিক-নদী-হাওর যুব সংগঠন, সোনাজুর গ্রামের অলি আহাদ ও আটপাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি উপজেলা ক্যাম্পাসে শতবর্ষী গাছে মাটির কলসী বেঁধে পাখি রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। কবিরাজ আ:হামিদ, রহিছ উদ্দিন শতশত ঔষধি গাছ রক্ষা করে চলেছেন। জেলে সংগঠক যোগেশ চন্দ্র দাস মাছের অভয়াশ্রম তৈরী করে স্থানীয় জাতের রক্ষার চেষ্টা করেন এবং চলমান রেখেছেন। কৃষক বাদশা মিয়া, গোলাম মোস্তফা মধু ভাই, মোজাম্মেল, সামছুন্নাহার, দুলাল মিয়া, কালাচান, জৈবকৃষি চর্চা করে মাটি পরিবেশকে ভালো রাখেন তখন আমরা আশান্বিত হই যে, এত প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার পরও আমরা গড়ে তুলতে পারবো আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ।