কীটনাশক ও কৃষকের কৃষি চর্চা

কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা

কৃষকের কৃষি প্রতিবেশের সৌন্দর্য্য কীট পতঙ্গকে নিয়েই। এতে ক্ষতিকর পোকা যেমন রয়েছে তেমনি উপকারী পোকাও রয়েছে। ক্ষতিকর পোকা দমনের জন্য বর্তমানে অধিকাংশ কৃষক প্যাকেটজাত কীটনাশকের প্রতি ঝুকছেন। IMG_20170302_105012কীটনাশক ব্যবহার শুধুমাত্র ধানের জমিতে নয়; শাকসবজি, ফুল, ফল ও অন্যান্য ফসল চাষের ক্ষেত্রেও, মাটির অণুজীবগুলো ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এমনকি ঘরের ভেতর পিপড়া, আড়শোলা, মশা ও ইদুর দমনের ক্ষেত্রেও। সবজি, মাছ, ফল ও ফুল টাটকা রাখার জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে ফরমালিন। ফলে আমরা বাতাশ, খাবার ও পানি গ্রহনের মাধ্যমে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। মানব স্বাস্থ্যে দীর্ঘ মেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী বিভিন্ন ধরনের রোগ বাসা বাঁধছে। এমনকি ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে প্রজনন স্বাস্থ্যও। চঅঘ অংরধ চধপরভরপ (চঅঘঅচ) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বিগত ৫ বছরে ১,১৪৮ জন শিশু কীটনাশকের বীষক্রীয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। তার মধ্যে মারা গেছে ৪২ জন। যাদের বয়স সর্বোচ্চ ১৭ বছরের মধ্যে। আর তারা প্রত্যেকে এশিয়া মহাদেশের শিশু।

উদ্বিগ্নের বিষয় হল যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই অপর আরেকজন কৃষক বা বিক্রেতার কাছ থেকে জেনে কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন। তাই এর ব্যবহারবিধি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেওয়ার সুযোগ কম থাকে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি ক্ষতি করছেন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের বাস্তসংস্থানকেও। সর্বোপরি ঝুকিপূর্ণ করে তোলছেন মানব স্বাস্থ্যকেও। এখানে কীটনাশক ব্যবহারকারী কয়েকজন কৃষকের কেইস সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।

কেইস ১
খারনৈ ইউনিয়নের গোড়াগাও গ্রামের কৃষক হোসেন মিয়া (৪২) একজন বড় কৃষক। তাঁর প্রায় ৭ একর জমি আছে। দু’ফসলী জমি। তিনি ধান ছাড়াও রবিশস্য ও সারাবছর শাকসবজি চাষ করেন। বোরো মৌসুমে তিনি ধানের জমির পোকা দমনের জন্য বাজারের কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন।Exif_JPEG_420

কেইস ২
রংছাতি ইউনিয়নের হাতিবেড় গ্রামের কৃষক হেমলেট থিগীদি (২৮) দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকুরিরত অবস্থায় সেখানে দিনাজপুরের কয়েকজন বন্ধু পেয়ে যান। তাদের এলাকায় বেড়াতে গিয়ে দেখেন তারা গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে শাকসবজি চাষ করেন। তাদের সবজি চাষে লাভবান হওয়ার গল্প শুনে ইচ্ছ জাগল গ্রামের পাহাড়ি এলাকায় পতিত পড়ে থাকা জমিগুলোতে সবজি চাষ করার।

Exif_JPEG_420

চাকুরি ছেড়ে গ্রামে এসে প্রায় ১০ কাঠা জমিতে টাকা বিনিয়োগ করে শুরু করেন এই বছরের শীতকালীন (লাউ, শিম, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, শশা, লাল শাক) সবজি চাষ। তাঁর দেখে আসা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বীজতলা তৈরি শুরু করেন এবং বাজার থেকে ১২০০ টাকার বীজ ক্রয় করেন। কিন্তু তিন চতুর্থাংশ বীজই অঙকুরোদগমন হয়নি। তাঁর সবজি চাষের প্রক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রথমে আমি এক-দেড় হাত পরিমাণ মাটি গর্ত করি। তারপর গোবর মাটি দিয়ে ভরাট করে মাটিতে থাকা পোকাগুলো মারার জন্য বীষ (কীটনাশক) দিই। এতে সব পোঁকা মারা যায়। এমনকি কেঁচো পর্যন্ত মারা যায়। তারা ঐভাবে চাষ করতো দেখে আমিও তাই করেছি।” তাঁর যা কয়েকটি চারা গজিয়েছিল সেগুলোও কয়েক মাস পর মারা যাওয়াতে কোন ফলন তিনি পায়নি। শ্রম, অর্থ, সময় ও অভিজ্ঞতা যা বিনিয়োগ করেছিলেন সবই তার বৃথা গেলো। ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কৃষিকাজ ছেড়ে অবশেষে ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য হন কাজের সন্ধানে।

কেইস ৩
দূর্গাপুর ইউনিয়নের চন্ডিগড় গ্রামের যুবক কৃষক সুজন মিয় (২৮) নাজিরপুর ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামে ৮০ কাঠা (৬৪০ শতাংশ) জমি লিজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চাল কুমড়া চাষ করেছেন। Exif_JPEG_420তিনি জানান, প্রতি সপ্তাহে তিনি ৮,০০০ টাকার কীটনাশক স্প্রে করেন।

কেইস ৪
কলমাকান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়নের কুয়ারপুর গ্রামের কৃষাণী মঞ্জুরা বেগম পারিবারিক খাদ্য চাহিদা মিটানোর জন্য এ বছর বসতভিটায় স্বল্প পরিমাণে শীতকালীন (লাউ, শিম, মিষ্টি কুমড়া) সবজি চাষ করেন। তার মধ্যে শিম গাছে পোকার আক্রমণ বেশি দেখা দেয়। তাই তিনি বাজারে গিয়ে বিক্রেতার কাছ থেকে কীটনাশক ক্রয় করে তাদের পরামর্শ অনুসারেই স্প্রে করেন। এতে তার পুরো শিম গাছ পুড়ে যায়। ফলশ্রতিতে ঐ বছর বাড়িতে চাষ করা শিম খাওয়া থেকে তারা বঞ্চিত হন।

নাজিরপুর ইউনিয়নের ভেলুয়াতলী গ্রামের কৃষক আব্দুল মোতালিব একজন জৈব কৃষি চর্চাকারী কৃষক। তিনি প্রত্যেক কৃষকের কাছেই জৈব বালাই নাশকের উপকারীতার কথা প্রচার করেছেন এবং প্রশিক্ষণও দিয়ে চলেছেন। বিষ ব্যবহারকারী কৃষকরাও তাঁর প্রশিক্ষণে অংশ নেন। সেই সাথে কীটনাশকের কারণে বাতাস ও চারপাশের পরিবেশ দূষিত হওয়ার মাত্রা জানাতে গিয়ে তিনি সব জায়গায়ই কীটনাশকের কারণে তাঁর পিতার শ্বাস কষ্ট হওয়া ও মারা যাওয়ার বিষয়টি। সেই থেকেই তিনি কীটনাশক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

আমাদের চারপাশে আরো অনেক কৃষক রয়েছেন যারা একসময় জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতেন। সময়ের বিবর্তনে আজ তাঁরাও প্যাকেট (কীটনাশক) পণ্যের প্রতি প্রভাবিত হচ্ছেন। এতে যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তেমনি অবহেলিত হচ্ছে স্থায়ীত্বশীল কৃষি চর্চার জ্ঞানগুলোও। বর্তমানে সরকারি কৃষি বিভাগও প্রাকৃতিক উপায়ে ক্ষতিকর পোকা দমনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করছেন। পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু পদ্ধতিগুলো পৌছাচ্ছে নির্দিষ্ট এলাকার কৃষকদের মাঝে। তাই আরো ব্যাপক প্রচারের জন্য প্রত্যেকের এগিয়ে আসা উচিত।

happy wheels 2

Comments