হামিদার জীবন সংগ্রাম
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
হামিদা আক্তার। তাঁর স্বামীর মো. আলাউদ্দিন। থাকেন লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের রামপুর গ্রামে। হামিদা আক্তারের দু’ছেলে ও একটি মেয়ে। হামিদা আক্তার স্বপ্ন দেখতেন সংসারের জীবনে প্রবেশ করে তিনি ভালোভাবে চলতে পারবেন, সন্তানদের সুন্দর করে মানুষ করতে পারবেন। সন্তানের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তাঁকে গর্বিত করবেন। তবে মানুষের জীবন সব সময় এক রকমভাবে চলে না। কখনো সুখ আবার কখনো দুঃখের সাথে সময় কাটাতে হয়। হামিদা আক্তার ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও বিয়ের পর তাঁর জীবনে অশান্তি আর অভাব নেমে আসে। স্বামীর বাড়িতে এসে নিশ্চিন্তে সংসার করা হয়ে উঠেনি। স্বামী কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। জমি জমাও তেমন একটা ছিল না। বসত ভিটার পনেরো শতাংশ জায়গা ছাড়া আর কোনো জমি নেই। স্বামী কাজ করে সারাদিন যা রোজগার করতেন, দিন শেষে জুয়া খেলে সব টাকা শেষ করে বাড়ি ফিরতেন।
হামিদা আক্তার দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে অনেক সময় না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তেন। দিনের পর দিন অনাহারে, অর্ধাহারে থাকতে গিয়ে জীবন যেন আর চলতে চাইছিলো না। সংসারের অভাব ঘোচাতে হামিদা আক্তার বাঁশ দিয়ে হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করলেন। সারাদিন পাখা বানিয়ে ছেলেদের দিয়ে বাজারে বিক্রি করাতেন। এই পাখা বিক্রির টাকা দিয়ে সংসারের অভাব পূরণ করতে লাগলেন। পাখা বিক্রির টাকা দিয়ে না হয় ভাত জোগার করা যায় কিন্তু পরার জন্য কাপড় কেনা যায় না।
তারপর তিনি গ্রামের এক প্রবীণ নারীর কাছ থেকে ধাত্রী বিদ্যার কাজ শুরু করলেন। কারণ এই কাজ করলে নতুন কাপড় পাওয়া যায়। এরপর থেকে তিনি নিজ গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামে ধাত্রীর কাজ করা শুরু করলেন। এতে করে তার কাপড়ের অভাবও আস্তে আস্তে দূর হতে লাগলো। তবে এই কাজও তো সব সময় থাকে না। তখন তিনি লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের এক দর্জির কাছ থেকে কাপড় চেয়ে নিয়ে তাতে হাতের সেলাই করে দিতেন। দর্জি যখন কাপড় কাটতো তখন তিনি দাঁড়িয়ে দেখতেন। বাড়িতে এসে গাছের পাতা, কাগজ দিয়ে সেই রকম করে কাটতে চেষ্টা করতেন। এভাবে তিনি আস্তে আস্তে কাপড় কাটা শিখে নিলেন। তাঁর আগ্রহ দেখে ওই দর্জি তাকে আরো ভালোভাবে কাপড় কাটার কৌশল শিখিয়ে দিলেন।
এরপর তিনি ঠিক করলেন সেলাই মেশিন কিনবেন। বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা এনে কিস্তিতে একটি সেলাই মেশিনও কিনে আনলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় তৈরির অর্ডার আনা শুরু করলেন। কারণ কেউ না জানলে তাঁর কাছে সেলাই করতে আসবেন কি করে? তাঁর সেলাই কাজের প্রচারণা পেয়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে নারী ও কিশোরীরা কাপড় সেলাই করতে নিয়ে আসতে লাগলো। এই সেলাইয়ের টাকা দিয়েই তিনি সংসারের যাবতীয় খরচ মেটাতে লাগলেন। তবে তখনও তাঁর স্বামীর বাজে অভ্যাস তবুও দূর হলো না। বরং আরো বেড়ে গেল। সারাদিন কাজ শেষে বাড়ি ফিরে হামিদাকে শারীরিরক নির্যাতনও করতেন। তবুও হামিদা সন্তানদের মুখ চেয়ে সব সহ্য করতেন।
সন্তানরাও এক সময় বড় হতে লাগলো। বাবার অত্যাচারের প্রতিবাদ করলে তাদেরকেও মার খেতে হতো। ভাতের অভাব দূর হলেও হামিদার সংসারে দুঃখ দূর হয়নি। সেলাইয়ের টাকায় সংসার চালানোর পাশাপাশি কিছু টাকা জমাতে লাগলেন এই চিন্তা করে যদি ভবিষ্যতে একটু জমি কেনা যায়। কিন্তু তাঁর ভাবনার সাথে ভাগ্য সহায় হলো না। হঠাৎ করেই তাঁর স্বামী অসুস্থ হয়ে গেলেন। আবার শরীরের এক অংশ অবশ (প্যারালাইসিস) হয়ে গেল। জমানো টাকার সবটুকুই স্বামীর চিকিৎসার কাজে ব্যয় করলেন। তবুও তাকে সুস্থ করতে পারলেন না। আজ প্রায় সাত বছর যাবৎ তিনি চলৎশক্তিহীন। হামিদা সেলাই করেই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেও বিয়ে করে আলাদা থাকে। তিনি এখন অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা ও পথ্যের খরচ যোগান দেওয়ার জন্য এখনও সেলাইয়ের কাজ করেন। গ্রামের দুইজন দরিদ্র নারীকেও তার সাথে রেখেছেন হাতের সেলাই করে দিতে। তাদেরকেও এর জন্য টাকা দেন। পাশাপাশি কেউ সেলাই শিখতে এলে তাকেও সেলাই শেখান। এভাবেই প্রায় চব্বিশ বছর ধরে তিনি কাপড় সেলাইয়ের মাধ্যমে নিজে বেঁচে আছেন এবং স্বামী, সংসারও টিকিয়ে রেখেছেন।