বাইর তৈরি করে রিফাতদের সংসার চলে

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে, জলাশয়ে পানি বাড়বে এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। এ বছরও এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। বরঞ্চ এবার বর্ষার সময়টা অন্যান্য বছরের তুলনায় দীর্ঘ হয়েছে। জলাশয়ে পানি বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে মাছের পরিমাণও। নদী, পুকুর বা বিলের মাছগুলো বাড়তি পানির সাথে ভেসে ধানের জমি বা কোনো নীচু জায়গায় চলে আসে। সেখানেই চলে মাছ ধরা। বর্ষার সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবার উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যাদের নিজস্ব পুকুর আছে তারা এ সময়ে পুকুরের মাছ ধরা থেকে বিরত থাকে। বছরের অন্যান্য সময়ের জন্য পুকুরের মাছ সংরক্ষণ করেন।
মাছ ধরার অনেক উপকরণের মধ্যে অন্যতম একটি উপকরণ হলো ‘বাইর’। নেত্রকোণা অঞ্চলে চ্যাং বাইর, বুন্দা বাইর ইত্যাদি নানা রকমের ‘বাইর’ অতি পরিচিত। বর্তমানে লম্বাকৃতির এক ধরণের ‘বাইর’ মাছ ধরার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।


সাধারণত বাঁশ দিয়ে এই ‘বাইর’ তৈরি করা হয়ে থাকে। বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই গ্রামের কুটির শিল্পীরা ‘বাইর’ তৈরি করা শুরু করেন। নিজের এলাকা ছাড়াও যে সমস্ত এলাকায় বর্ষার পানি বেশিদিন স্থায়ী হয়, সে সকল এলাকায় বাইরের চাহিদা থাকে বেশি।


লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের লক্ষীগঞ্জ গ্রামের ছোট্ট রিফাত। সে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়ে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। এই অবসর সময়ে সে তার দাদা, দাদীর সাথে ‘বাইর’ তৈরির কাজে যুক্ত হয়েছে। দাদা যখন ‘বাইর’ তৈরির কাজ করতো, তখন সে দাদার পাশে বসে থেকে দেখতো। দাদার কাজে সাহায্য করতো।
এভাবেই কয়েকদিনে সে ‘বাইর’ তৈরি করতে শিখে গেছে। এখন সে নিজেই তৈরি করতে পারে। এটি তৈরির জন্য প্রথমে বাঁশকে ছোট আকারে কেটে চিকন শলাকা তৈরি করতে হয়। এরপর একটার পর একটা শলাকা সুতো দিয়ে বেঁধে এগিয়ে চলে ‘বাইর’ তৈরির প্রক্রিয়া। একটা লম্বাকৃতির ‘বাইর’ তৈরি করতে রিফাত এর দুই থেকে তিনদিন সময় লেগে যায়। রিফাত বাঁশের শলা তৈরি করতে পারেনা। এ কাজে তার দাদী তাকে সাহায্য করে। সে শুধু বাইন করে।


পাইকারি হিসেবে বিক্রি করলে প্রতিটি ‘বাইর’ পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারে। এছাড়া খুচরা বিক্রি করলে প্রতিটি এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়। অনেকে অগ্রিম টাকা দিয়ে যায় ‘বাইর’ কেনার জন্য। স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি হাওড় এলাকার পাইকারগণ কিনে নেয়।
এই লম্বা ‘বাইর’ এ বিভিন্ন ছোট মাছ ছাড়াও পাবদা, বাইম, চিকরাসহ অন্যান্য মাছ ধরা যায়। স্থানীয় বিল, হাওড় বা অন্যান্য জলাশয়ের এসমস্ত মাছের চাহিদা প্রচুর। কারণ এগুলো খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। প্রতি কেজি এসব মাছের বাজার মূল্য প্রায় চারশত টাকা।


নেত্রকোণা অঞ্চলের অনেক পরিবার এ সময়ে ‘বাইর’ বিক্রির উপর নির্ভরশীল। একটা বাঁশ দিয়ে ২/৩টা ‘বাইর’ তৈরি করা যায়। এটি তৈরি করতে খরচ বেশি হয়না। রিফাতদের বাঁশ নেই, তারা অন্যের বাড়ি থেকে কিনে আনে। বর্ষাকালে বাঁশের তেমন দাম থাকেনা। এক হালি বাঁশ ছয়শ’ থেকে সাতশ’ টাকায় কেনা যায়।


রিফাতের পরিবার শুধু ‘বাইর’ বিক্রিই করেনা, তার দাদা বাইরের সাহায্যে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করেন। এগুলো বিক্রি করে যা উপার্জন হয় তা দিয়ে রিফাতের পরিবারের সকল চাহিদা পূরণ হয়। কারণ তাদের বসতভিটা ছাড়া কোনো জমি নেই। লক্ষীগঞ্জ বাজারের একপাশে, মগড়া নদীর পাড়ে ছোট্ট একটি ঘর তুলে সেখানে বসবাস করে। বছরের অন্যান্য সময় রিফাতের দাদা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।


গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ পরিবারের শিশুরা তাদের অভিভাবকদের সাথে পারিবারিক অর্থনৈতিক কর্মকাÐে যুক্ত থাকে। পাশাপাশি লেখাপড়াও চালিয়ে যায়। যে সমস্ত পরিবার যে ধরণের পেশা অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে, সে সমস্ত পরিবারের শিশুরা বংশ পরম্পরায় বিভিন্ন কাজে দক্ষ হয়ে উঠে। রিফাত তেমনই একজন শিশু যে লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের পরিবারের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণে অবদান রেখে চলেছে। অবসর সময়টুকু কাজে লাগিয়ে কুটিরশিল্পী হিসেবে নিজেকে তৈরি করছে। পাশাপাশি বাকি সময়টুকু সমবয়সীদের সাথে খেলাধূলা ও পড়ালেখাও করছে।

happy wheels 2

Comments