‘পুষ্টির ফেরিওয়ালা’ রুহুল কুদ্দুস রনি
সাতক্ষীরা থেকে শেখ তানজির আহমেদ
প্রকৃতির কবি রুহুল কুদ্দুস রনি। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তঘেঁষা উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার তালতলা গ্রামের মাঝের পাড়ায় সাইকেল মিস্ত্রী আব্দুল শুকুর ও গৃহিনী কহিনুর উন্নেছার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাদের চার ভাই, দুই বোন ও বাবা-মা নিয়ে আটজনের সংসার।
১৯৯০ সালের কথা। তখন সাতক্ষীরা শহরে এতো ভ্যান-রিক্সা ছিল না। ছয় সন্তানের মুখে কিভাবে দু’মুঠো অন্ন যোগাবেন, সেই চিন্তাতেই দিন-রাত পরিশ্রম করতেন আব্দুল শুকুর। হাড় ভাঙা খাটুনিতে এক পর্যায়ে গ্যাস্ট্রিক আলসারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অর্থের অভাবে সুচিকিৎসা নিতে না পারায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আব্দুল শুকুর।
অভাব-অনটনের কারণে মা পাড়া থেকে ভাত চেয়ে এনে খাওয়াতেন তাদের। পাঁচ টাকা কেজিতে কেনা ক্ষুদের ভাত খেয়ে পার হতো একেকটি দিন। এরপরই শুরু হয় রুহুল কুদ্দুস রনির জীবন সংগ্রাম।
অর্থাভাবে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে তার। জীবন সংগ্রামে রুহুল কুদ্দুস রনি সঙ্গী করে নেন প্রকৃতিকে। প্রথম জীবনে মাঠ থেকে ঘাস কেটে বাজারে বিক্রি করতেন তিনি। পরে ডালায় করে কচুশাক, কলমি শাক তুলে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রয় করা শুরু করেন। পরে শুরু করেন আইসক্রিমের বিক্রি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে গোটা পরিবারের দায়িত্ব চেপে বসলো রুহুল কুদ্দুস রনির ঘাড়ের উপর। তারপর একটানা প্রায় পাঁচ বছর চলে ইট ও পাথর ভাঙার কাজ। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ইট আর পাথর ভাঙতে মেশিন আসলে বেকার হয়ে পড়েন তিনি। এরপর কিছুদিন রিক্সা চালান। হঠাৎ একদিন জাহিদ নামে এক শিশু শ্রমিককে অনুকরণ করে ফের সাতক্ষীরা নৈশ স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সেখানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও এসএসসি পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি রনির। এতোদিন পর্যন্ত রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন তিনি। তখনই হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল ছোট বেলার কথা।
ডালায় করে কচুশাক, কলমি শাক বিক্রির ছোট বেলার সেই জীবনে ফিরে যান রনি। তবে, ছোট বেলায় অভাব অনটনের কারণে করলেও প্রাপ্ত বয়সে এসে জীবন সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি ঘটে তার। তিনি চিন্তা করেন, এতে যেমন পূর্বের তুলনায় আয় বৃদ্ধি সম্ভব, তেমনি প্রকৃতি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া শাক-সবজি সার-কীটনাশক মুক্ত এবং প্রচুর আয়রণ, ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ, যা মানুষকে কুড়িয়ে পাওয়া শাক-সবজি সংরক্ষণ ও ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করবে। একই সাথে মানুষের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়াবে।
রুহুল কুদ্দুস রনি জানান, প্রকৃতিতে পুষ্টির অফুরন্ত ভা-ার রয়েছে। কচুশাক, কলমি শাক, ব্রাহ্মি, পেপুল, গাধমনি, তেলাকচু, বৌটুনি, কাটানটি, থানকুনি, শাপলা, হেলাঞ্চ, ডুমুর, মোচা, আমরুল, গিমা- এসব শাক-সবজিতে চাষকৃত সবজির চেয়ে বেশি পুষ্টিগুণ রয়েছে। খেতে ভালো, স্বাদে মানে ও গুণে অনন্য এবং আমাদের গ্রামাঞ্চলে খাল, বিল, হাওড়, ডোবা, পুকুর ও ঘেরে সারা বছর এসব শাক-সবজি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, “কুড়িয়ে পাওয়া এসব শাক-সবজি যদি প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা যায় তাহলে পুষ্টির অভাব দূর হবে, খাদ্যের ঘাটতি পূরণ হবে, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের সেবা ও কল্যাণ সাধন হবে।”
প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত এসব শাক-সবজি মানুষের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রুহুল কুদ্দুস রনি একটি ভ্যান ক্রয় করে তাতে চার-পাঁচটি ছালা আর কয়েকটি ঝুড়ি দিয়ে সুন্দর করে সাজান। এরপর ঝুড়ি-কাচি নিয়ে শাকের সন্ধানে ছুটে চলেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
পুকুর, হাওর, খাল, বিল থেকে সংগ্রহকৃত শাক-সবজি বাড়িতে নিয়ে আসার পর পরিবারের সদস্যরা মিলে সেগুলো পরিষ্কার করা হয়। কেউ আঁটি বাঁধে, কেউ বেঁধে দেয়। পরে সেগুলো ভ্যানে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে সন্ধ্যার পরে শহরের অলি-গলিতে বের হয়ে পড়েন রুহুল কুদ্দুস রনি। মোড়ের দোকানগুলোতে জ্বলতে থাকা মৃদু আলোতে চলে বেচাকেনা। কেউ কেনেন কচুশাক, কলমি শাক বা ব্রাহ্মি। কেউবা পেপল, গাধমনি বা তেলাকচু। আর বৌটুনি, কাটানুটি, থানকুনি, শাপলা, হেলাঞ্চ, ডুমুর, মোচা, আমরুল, গিমাসহ হরেক রকমের শাক-সবজি তো আছেই। শহরের সর্বস্তরের মানুষ এখন রুহুল কুদ্দুস রনির ক্রেতা। আর কার্যক্রমে উৎসাহ যোগাতে এবং কুড়িয়ে পাওয়া শাকের সংরক্ষণ ও ব্যবহার বৃদ্ধিতে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে বারসিক রহুল কুদ্দস রনির পাশে দাঁড়ায়। তাকে প্রদান করে পুষ্টির ফেরিওয়ালা শীর্ষক ফেলোশিপ। রুহুল কুদ্দুস রনিকে এখন সাতক্ষীরা জেলাবাসী চেনে। শহরে তার অনুপস্থিতিতে খোঁজ পড়ে যায় রুহুল কুদ্দুস রনির।
বহুগুণের অধিকারী রহুল কুদ্দুস রনি লেখেন কবিতাও। এ পর্যন্ত সাতক্ষীরার স্থানীয় বিভিন্ন দৈনিক ও অসংখ্য সাহিত্য গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতা।
তিনি লিখেছেন,
সার নাই বিষ নাই, চাষকৃতও কিছু নয়,
অযতেœ অবহেলায় মাঠের মধ্যে পড়ে রয়,
ঘাস নয় আগাছা নয়, ভিটামিনে ভরপুর
পুষ্টির অভাব নাই, সৃষ্টিতে অপরুপ
আয়রন আর খনিজ লবণ আছে বেশি বেশি,
হিসাব কষে দেখা যাবে হেরে যাবে চাষী,
সবুজ লতা-পাতা আজ সবজির পাশে
বারসিকের উদ্যোগে সুস্বাস্থ্য বিকাশে,
কচুশাক, কলমি শাক, পেপুলি আর হেলাঞ্চ
থানকুনি, তেলাকচু, বৌটুনি আর মালঞ্চ
শাপলা সঞ্চি পাতার সাথে দেব আরো কলমি
মাথার মগজ ঠা-া রাখতে সাথে আছে ব্রাহ্মি
কাটানুটি গাঁধমনি আমরুল শাকের কথা
বেলে শাকের সাথে দেব মজার আরো এক শাক পাতা।
শাকের পাশাপাশি কিছু আছে সবজি
সার নাই বিষ নাই, পায় বার মাসি।
ডুমুর উঠে বলে আমারে খাও,
ডায়াবেটিস থাকবে না, হবে না কাবু,
তিত বেগুণে এলার্জি আরো সারে কঠিন কাশি
কচুর লতি যত পার খাও বেশি বেশি।
সবুজ পাতা খেতে ভারি মজা
তুমি ওরে সাথি কর চোখ থাকবে তাজা।
এসব সবজি তুমি পাবে পুষ্টির ফেরিওয়ালার কাছে
এইসব শাকে ঔষধি গুণ ষোল আনা রয়
বৃদ্ধ নয়, যুবক হও এই পণ সব সময়।
পুষ্টির ফেরিওয়ালা খ্যাত কবি ও প্রকৃতি সাধক রুহুল কুদ্দুস শুধু শাক লতাপাতা বিক্রিই করেন না, তিনি সহজেই বলতে পারেন এসবের গুণাগুণ।
রুহুল কুদ্দুস শাক লতাপাতা বিক্রির সময় মানুষকে পুরোনো দিনের সেই চর্চার কথা মনে করিয়ে দেন। মা-খালা, নানী-দাদিরা ঠিক যেমনটি বলতেন, থানকুনি খেলে পেটের অসুখ ভালো হয়। এছাড়া প্রতিদিন সকালে খালি পেটে থানকুনির চারটি করে পাতা চিবিয়ে খেয়ে এক গ্লাস ঠা-া পানি খেলে পাঁচটি রোগের কাজ করে। এতে আমাশয় দূর হয়, গ্যাস্ট্রিক ভালো হয়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে, মাথার চুল পড়া বন্ধ হয়ে যায় ও চোখের জ্যোতি বাড়ে।
কচুশাকে চোখের জ্যোতি বাড়ে, রক্তের ঘাটতি পূরণ করে, পায়খানা পরিষ্কার করে। আর কচুর ডাটায় থাকে আয়রণ ও ভিটামিন সি।
শাপলা ফুলে আছে পানি, আয়রন ও ভিটামিন এ। তেলাকচুর পাতা রস করে সকালে খালি পেটে খেয়ে ঠা-া পানি খেলে ডায়াবেটিস কমে যায়। এছাড়া আখের চিনি ও ছাগলের দুধের সাথে খালি পেটে খেলে গ্যাস্ট্রিক ও আলসার ভালো হয়। এতে আছে আয়রণ, খনিজ ও ভিটামিন ছাড়াও ১৬টি উপাদান।
কলমি শাখে আছে ভিটামিন বি ও আয়রন। কলমি শাক পায়খানা নরম করে। ব্রাহ্মি একটি তিতু শাক। তবে খেতে খুব ভালো। বাহ্মি মাথা ঠা-া করে প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। এর রস শরীরের জন্য খুব উপকারী। গালে ঘা অথবা কাশি সারে। এতে আছে আয়রন, এসিড, ভিটামিন ডি ও আরো অনেক উপাদান।
হেলাঞ্চ শাকে গ্যাস্ট্রিক ভালো করে, লিভার ও রক্ত পরিষ্কার করে, কৃমি ও কোষ্ঠকাঠিন্য ভালো করে, পাকস্থলি ও কিডনি ভালো রাখে। এলার্জিও কমায়। এতে ২৬টির মতো উপাদান আছে।
এছাড়াও কুড়িয়ে পাওয়া হরেক রকমের শাকের গুণাগুণ অনায়াসেই বলতে পারেন প্রকৃতির সাধক রুহুল কুদ্দুস রনি।
রুহুল কুদ্দুস রনি বলেন, “মানুষ এগুলো নিজ বাড়িতে সংরক্ষণ করে ওষুধের ভা-ার গড়ে তুলতে পারে। একই সাথে বিনা খরচে মিটাতে পারে পুষ্টির চাহিদা।
রুহুল কুদ্দুস রনির কর্মকা- সম্পর্কে গবেষক শাহীন ইসলাম বলেন, “রুহুল কুদ্দুস রনি প্রকৃতি থেকে সংগৃহীত শাক লতা-পাতা থেকে জীবন জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি তা সংরক্ষণ ও ব্যবহার সম্পর্কে যে প্রচারণা চালাচ্ছেন তা অত্যন্ত সময়োপযোগী। তার কর্মকা-ের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।”