প্রান্তিক নারীর আয় বৃদ্ধিতে দেশীয় জাতের মোরগ-মুরগি পালন
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন
ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে পারিবারিক যতেœই প্রাণিসম্পদ লালন-পালন করা হয়। বর্তমানে অসংখ্য ছোটবড় বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামার গড়ে উঠলেও বসতবাড়িতে দেশী জাতের মোরগ-মুরগি পালন আজও গ্রামীণ পরিবারের গৃহস্থালি আয়বর্ধনের একটি হাতিয়ার, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নেও অন্যতম ভূমিকা রাখছে।
প্রমত্তা পদ্মার কোল ঘেঁসে আলগিচর গ্রাম। মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলা রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের অধীন এই গ্রামের প্রান্তিক এক পরিবারের গৃহবধু শারমিন বেগম (৩২)। স্বামী আর সন্তান নিয়ে তার সংসারের ছোটখাট আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে তিনি দেশীয় জাতের মোরগ-মুরগি পালন করছেন। নিজের প্রসাধন কেনা, হাত খরচ, ছোটখাট পারিবারিক প্রয়োজন পূরণ, সন্তানদের বায়না ও স্কুল যাতায়াতের ব্যয় মেটাতে সময় স্বামীর মুখাপেক্ষী যাতে হতে না হয় সে জন্যই তিনি বিয়ের পর থেকেই বসতবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দেশীয় জাতেরমোরগ-মুরগি পালন করছেন। তার মাও দেশীয় জাতের মোরগ-মুরগি পালন করতেন যা দেখে তিনি শিখেছেন ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। বিয়ের আগে মায়ের সাথে তিনি মুরগির খাবার দেওয়া, খোপে (ঘর) মোরগ-মুরগি ঢুকানো, সকালে ছেড়ে দেওয়া, খোপ থেকে ডিম সংগ্রহ করাসহ বিভিন্ন কাজে মাকে সহযোগিতা করতেন।
বিয়ের পর শারমিন স্বামীর বাড়িতে এসে স্বামীকে মুরগি পালনের আগ্রহের কথা জানালে তিনি স্থানীয় বাজার থেকে পাঁচটি দেশী মুরগি পালনের জন্য পাঁচশত টাকায় কিনে দেন। একই সাথে তার স্বামী তাকে মুরগির ঘর নির্মাণেও সাহায্য করেন। বর্তমানে শারমিনের বাড়িতে ৩০টি ছোট-বড় মোরগ-মুরগি রয়েছে। তার মধ্যে ১২টি মুরগি ডিম দিচ্ছে। শারমিন বেগম জানালেন, দেশি মোরগ-মুরগির খাবারের কোনো ঝামেলা নাই, বাজার থেকে কেনা খাবার খাওয়াতে হয় না। তবে সকালে ঘর খুলে মোরগ-মুরগি বেরিয়ে এলে কিছু চালের খুদ, গম, ধান, চাল ও দানাদার খাবার দেন। একইভাবে সন্ধ্যায় মুরগি ঘরে ওঠার আগে কিছু খাবার দেন। মোরগ-মুরগি সারাদিন বাড়ির আশেপাশে ঘুরে ফিরে খাবারে উচ্ছিষ্টাংশ ভাত, তরিতরকারি, চালের খুদ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধান, গম, সরিষা, কালাই, পোকামাকড়, অচাষকৃত শাক উদ্ভিদের লতাপাতা, ঘাস, পাথর কুচি ইত্যাদি খেয়ে সন্ধ্যা হলে আপনাআপনি ঘরে ফিরে আসে। তিনি মাঝে মাঝে মুরগির ঘর পরিস্কার করে দেন।
তিনি মোরগ-মুরগি সাধারণত উন্মুক্ত পদ্ধতি বা ছেড়ে দিয়ে পালন করলেও হরিরামপুর উপজেলা বন্যা প্রবণ হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে শিয়াল, খাটাস, বেজি, গুইসাপ’র আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সে সময় মোরগ-মুরগি আবদ্ধ জায়গায় রাখেন। সাধারণত মাচার উপর মশারি ও নাইলনের নেট বা বেড়া অথবা বাঁশের চেগার দিয়ে আবদ্ধ ঘের বানিয়ে তার মধ্যে মোরগ-মুরগি রাখেন। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মুরগি পরিচর্যার জন্য বাড়তি মনোযোগ বা লোকজনেরও তেমন দরকার পড়ে না। তবে শিয়াল, বেজি, গুইসাপ, বিড়াল, কুকুর ও খাটাসের আক্রমণ থেকে সতর্ক থাকতে হয়। তবে দেশী জাতের মোরগ-মুরগি আক্রান্ত হলে সশব্দে প্রতিহত করে বলে পালনকারীও সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেন। কোনো কোনো দেশী জাতের মোরগ-মুরগি বাড়ির মানুষ ছাড়া অন্য কেউ কাছে গেলেই তেড়ে এসে পায়ের নক দিয়ে আঁচড় দেয়।
দেশী জাতের মোরগ-মুরগির রোগবালাইও তেমন হয় না বলে তিনি জানান। একটি দেশী মুরগি গড়ে ১৫ থেকে ১৮টা পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। ১ হালি বা ৪টি ডিম ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। আশ-পাশের মানুষই কিনে থাকেন। আবার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে ডিম কিনে। শারমিন জানালেন, তারা নিজেরাও কিছু ডিম খেয়ে থাকেন বা কখনো কখনো আত্মীয়স্বজনকে দেন।
গ্রামের বসতবাড়িতে দেশী মোরগ-মুরগি পালনকারী কয়েকজন নারী জানালেন, যেহেতু নারী তত্ত¡াবধানেই বসতবাড়িতে দেশী মোরগ-মুরগি পকরা হয় বলে আয়ের টাকা নারীরা নিজের প্রয়োজন ও খুশি মতো খরচ করতে পারেন। তবে হাঁস, মুরগি বাজারে বিক্রি করার ক্ষেত্রে বাড়ির পুরুষরাই বাজারে বেশি নিয়ে যান। অবশ্য কখনও কখনও পরিবারের প্রয়োজনে নারীরাও নিজে হাট-বাজারে মুরগি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে থাকেন।
স্থানীয় এলাকায় দেশীয় জাতের মোরগ-মুরগি ক্রমশ বিলুপ্তি পথে। আন্ধারমানিক গ্রামের আরেকজন প্রান্তিক নারী আয়শা বেগম জানান, হরিরামপুর উপজেলার বাহিরচর, আলগিচর, পিয়াজচর, আন্ধারমানিক এবং চরাঞ্চলসহ প্রায় প্রতিটি পরিবার আগে গলাছেলা মুরগি, আমনামুরগি, ঝুঁটিয়ালা, খইয়া, টুইরা জাতের মুরগি পালন করতেন যার অধিকাংশই এখন প্রায় বিলুপ্ত। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িতেই আমনা জাতের মুরগি ছিল। প্রতিবার ডিম পাড়া শুরু হলে ১০-১২টা পর্যন্ত ডিম দিত এবং বাচ্চা তোলার ১৩-১৪ দিন পর বাচ্চা ছেড়ে দিয়ে পুনরায় ডিম পাড়া শুরু করত।’
বারসিক ২০১৭ সাল থেকে মানিকগঞ্জ এলাকায় গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন ও প্রাণিসম্পদের দেশীয় জাতবৈচিত্র্য সুরক্ষায় পরিস্থিতি অনুসন্ধানে জন্য সমীক্ষা পরিচালনা করে। পরবর্তীতে কৃষকের বাড়িতে দেশীয় জাতের প্রাণিসম্পদের প্রায়োগিক গবেষণা, জাতবর্ধন, উদ্বুদ্ধকরণ আলোচনা, ভ্যাকসিনেশন, লোকায়ত পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানো, ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও কর্মশালাসহ নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান চিরন্তন। প্রান্তিক পরিবারের আয়বৃদ্ধি তথা সমৃদ্ধি অর্জনে নারীর স্বতঃষ্ফূর্ত অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। অন্যদিকে কৃষির প্রধান উপখাত হিসেবে প্রাণিসম্পদ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে আমিষের চাহিদা পুরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জাতীয় আয় বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় সরকারও প্রাণিসম্পদ খাতকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান যদি দেশীয় জাতের প্রাণিসম্পদের বাজার চাহিদা ও উপযোগিতা আমলে নিয়ে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ করে তবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠি যেমন উপকৃত হবেন তেমনি প্রাণিসম্পদের দেশীয় এই জাতগুলোও ভবিষ্যৎ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।