আদিবাসীদের কথা বলি
সিলভানুস লামিন
এক
প্রতিবছরই ৯ আগস্ট আসে, যায়। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন হয় বেশ আড়ম্বর করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীরা এ দিবস পালন করেন, কেউ ঢাকায়, সিলেটে, রাজশাহী, রংপুরসহ নানান জেলা শহরেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ঢাকায় কিংবা নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে এবং হাতে নানান দাবি-দাওয়া সম্বলিত পোস্টার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে এ দিবসটি পালন করেন আদিবাসীরা। নাচ-গান ও শান্তিপূর্ণ র্যালির মাধ্যমে তারা এদিন উৎসব করেন। কারণ কেবল এই একটিমাত্র দিনে সব আদিবাসী একত্র হয়ে কাঁধে কাঁধ রেখে তাদের বিভিন্ন দাবি তুলতে পারেন, তাদের ওপর নির্যাতনের ইতিহাস বর্ণনা করতে পারেন। এদিন গণমাধ্যম কর্মী থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের একাংশও এই দাবি-দাওয়ার সাথে সংহতি প্রকাশ করেন, ছাপা, সম্প্রচার ও সোশাল মাধ্যমে আদিবাসীদের ছবি ও সংবাদ স্থান পায়; আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তারা জোরালো বক্তব্য দেন; দু’একদিনে এই ইস্যুটি নিয়ে আলোচনাসভা, সেমিনার হয়। জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তি সেই সেমিনারে আলোচনা করেন, বিভিন্ন নীতিমালা, আইন প্রণয়ন ও স্বীকৃতি প্রদানের সুপারিশ করেন। আদিবাসী নেতারাও অনেক ব্যস্ত থাকেন এ দিন। তাদের সাক্ষাতকার নেওয়ার জন্য মিডিয়ার লোকজন বসে নেই। বিভিন্ন এনজিও যারা আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নকল্পে ‘কর্মসূচি’ পরিচালনা করেন তারাও এ দিনকে কেন্দ্র্র করে সপ্তাব্যাপী বা টানা দু’তিনদিন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা করে। তবে এ পর্যন্তই!! বছরের বাকি সময়টা মিডিয়ায় আদিবাসীদের অস্তিত্ব খুঁজেই পাওয়া যায় না। কদাচিৎ দু’একটা খবর আসলেও সেটা ইতিবাচক নয়; নেতিবাচক সংবাদ। হয়তো কোনও আদিবাসী মেয়ে নির্যাতিত হয়েছে, কিংবা কোনও আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসতভিটা-জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে অথবা কোন আদিবাসী নেতা খুন হয়েছেন ইত্যাদি জাতীয় খবর।
দুই
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে যাদের বঞ্চনা ও অধিকারহীনতা বিষয়টি তুলে ধরার কথা সেই সাধারণ আদিবাসীরা কী পেল? অনেকে বলবেন, আদিবাসী ইস্যু গণমাধ্যমে ব্যাপক স্থান পেয়েছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আদিবাসী ইস্যুর ক্ষেত্রে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, আদিবাসীরা আগের তুলনায় নিজেদের সংগঠিত করতে পেরেছেন, আদিবাসীদের দাবি-দাওয়ার সাথে সংহতি প্রকাশ করতে সুশীল সমাজের অনেকে এগিয়ে আসছেন, আদিবাসী নেতা ও গবেষকের ব্যাপক আর্বিভাব ঘটেছে, অনেক এনজিও আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এবং আদিবাসীরা ওই এনজিওগুলোতে ‘কাজ’ করার অভিগম্যতা লাভ করেছে, আদিবাসীদের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠনসহ অনেক সামাজিক সংগঠন ও এনজিও আত্মপ্রকাশ করেছে প্রভৃতি। মূলত পর পর দু’টি আদিবাসী দশক (১৯৯৫-২০০৪ এবং ২০০৫-২০১৪) ঘোষণার পর থেকে আদিবাসী ইস্যুটি বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা সত্যি। তবে আদিবাসী দশককে পুঁজি করে অনেকে বাণিজ্যও করেছেন, অনেকে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য এটিকে কাজে লাগিয়েছেন, আবার অনেকে আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য দাতাসংস্থাদের কাছ থেকে বিপুল ‘অর্থকড়ি’ আদায় করতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু যাদের জন্য এই এত আয়োজন তাদের তো কিছুই হয়নি। বরং আদিবাসীরা আজও নানান নির্যাতন, বঞ্চনা, শোষণ, হয়রানি ও অবহেলার শিকার হয়েছেন। আদিবাসীদের ভূমি দখল করার পায়তারা অব্যাহত রয়েছে। সিলেটে খাসি, গারো, পাত্রদের ভূমি, পাবর্ত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাসহ ১১ জাতিসত্তার ভূমি, রাজশাহী ও রংপুরে সাঁওতাল, ওরাঁরওদের ভূমি এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ গারো, হাজং, ডালু, কোচদের ভূমি নানান সময়ে দখল করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভূমি দখলের পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতনের হার আগের যেকোন সময়ের চেয়েও বেশি সংঘটিত হয়েছে। আদিবাসী নারী ও কিশোরীরা শ্লীলতাহানি ও হত্যার শিকার হচ্ছেন বারবার। তাই শুধু আগস্ট মাস নয়; বছরব্যাপীই আদিবাসী ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করা উদ্যোগ নিতে হবে, আদিবাসীদের অবদান, আদিবাসীদের সম্ভাবনাসহ তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরার উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের স্বীকৃতি লাভের দাবিগুলো আরও দ্রুত ও জোরালোভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের দরবারে পৌছাবে।
তিন
কোন বিষয়ে জনমত তুলে ধরার জন্য মিডিয়া বা গণমাধ্যম ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। আজ বাংলাদেশে অনেকগুলো গণমাধ্যম আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়ার সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে এই মাধ্যমে কাজ করার মতো দক্ষ ও যোগ্য কর্মীও! এই দু’টি মাধ্যম ছাড়াও বর্তমানে সোশাল মিডিয়াও খুবই সক্রিয় একটি মাধ্যম। আমরা স্বীকার করি, রাষ্ট্রে ও সুশীল সমাজের কাছে আদিবাসীদের নানান বিষয় ও ইস্যু এ গণমাধ্যমগুলোই তুলে ধরেছে, আদিবাসীর পরিচিতি তুলে ধরেছে এবং আদিবাসীদের অধিকার আদায়সহ নানান দাবি দাওয়া রাষ্ট্রযন্ত্র ও নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌছাতে ভূমিকা রেখেছে। তবে আমরা যদি খেয়াল করি, তাহলে দেখতে পাবো যে, এসব মিডিয়াতে আদিবাসীদের ইতিবাচক সংবাদ ও ফিচারের তুলনায় নেতিবাচক সংবাদ বা ফিচারের সংখ্যাই বেশি। আদিবাসীরা খুন হয়েছেন, শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন, জমি দখল হয়েছে, উচ্ছেদ হয়েছেন, দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন এসব শিরোনামের সংবাদগুলোই জাতীয় পত্রিকাতে দেখতে পাই বেশির ভাগ সময়ে! মূলধারার খুব কম জাতীয় গণমাধ্যমেই আদিবাসীদের নিয়ে ইতিবাচক সংবাদ বা ফিচার করতে দেখেছি; করলেও এ সংখ্যা খুবই নগণ্য! অথচ আদিবাসীদের বহুমাত্রিক অবদান নিয়ে এ জাতীয় গণমাধ্যমগুলো ফিচার করতে পারতো! মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে কৃষি উৎপাদন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমাজ সংস্কারের এদেশের ৩০ লাখের অধিক আদিবাসীদের অনেক অবদান রয়েছে। এছাড়া এদেশের সংস্কৃতিকে নানানভাবে বৈচিত্র্যমণ্ডিত করেছে আমাদের আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও বিভিন্ন ভাষাগুলো। আদিবাসীদের সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি যদি ইতিবাচক সংবাদও পরিবেশন করা হয় তাহলে আদিবাসীদের ইস্যু ও প্রয়োজনগুলো সরকারের দৃষ্টিতে পড়বে। কে জানে ইতিবাচক এসব সংবাদ ও ফিচারের মাধ্যমেই আদিবাসীদের সম্পর্কে সরকার তথা নীতিনির্ধারক যারা আছেন তারা সহনশীল হবেন!
চার
এবারের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়, আদিবাসীদের নিয়ে একসাথে দরকার একটি নতুন সামাজিক সংযোগ ও সংহতি।’ অর্থ্যাৎ রাষ্ট্র থেকে শুরু বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনগুলো যা কিছু করবে, যা উন্নয়ন করবে, দেশের জন্য যা কিছু পরিকল্পনা করবে সেই সব প্রক্রিয়াতেই আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা থাকবে। আদিবাসীদের নিয়েই এসব উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হবে। দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাথে আদিবাসীদের একটি নতুন ইতিবাচক সংযোগ ও সংহতি তৈরি হবে। তাই আশা করছি, এবারের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টির ওপর জোর ও গুরুত্বারোপ করে আদিবাসীদের সঙ্গে নিয়েই তাদের সত্যিকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ধারা সূচিত হবে; বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এই উদ্যোগ ও কর্মসূচিতে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের হার বেশি হবে। আদিবাসীদের পরামর্শে ও মতামতের ওপর ভিত্তি করে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। আমরা আরও আশা করি, এরপর থেকে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা, পেশা বিপন্ন হবে না। আদিবাসীদের বেদখল হওয়া জমি-বসতভিটা উদ্ধারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণকৃত জমির ন্যায্যমূল্য পাবে। ভূমি ও জীবিকার জন্য কোনও আদিবাসীর প্রাণ ঝরে যাবে না। আদিবাসী মা-বোন নির্যাতনের শিকার হবে না। কারণ আদিবাসীদের পেছনে ফেলে না দিয়ে তদের অর্থনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠিত করা হলে তাদের সামাজিক চাহিদা ও প্রত্যাশাগুলো পূরণ হবে বলে মনে করি। এ বিষয়ে সরকারসহ সুশীল সমাজের সৃদৃষ্টি কামনা করি।
ফিচার ছবি: সাজু মারছিয়াং