একটি ধান ও সোনা মিয়ার জীবন
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
জীবনের প্রয়োজনে গ্রাম বাংলার অনেক পরিবার শহরে চলে আসে। শহরে আসতে গিয়ে, পরিবার পরিজনকে ছেড়ে যেতে যেমন কষ্ট হয়, সেই সাথে কষ্ট হয় নিজের গ্রাম, গ্রামের মাঠ, নদী, পুকুর,গাছপালা, এমনকি গাছের ডালে ভোর বেলায় ডেকে উঠা পাখির জন্য এক ধরনে চাপা কষ্ট হয়। এমনি অনেক মানুষ দিনের পর দিন ঢাকা শহরে কোন কারখানার বদ্ধ বাতাসে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মিনিট, ঘন্টার হিসেব করে কাজ করে যান শুধু কিছু অর্থ রোজগার করে বাড়িতে পাঠানোর জন্য। যেখানে কারও মা, বাবা কারও স্ত্রী ছেলে মেয়ে পথ চেয়ে বসে থাকে।
এমনি একজন মানুষ নেত্রকোনা জেলা, আমতলা ইউনিয়নের গাছগড়িয়া গ্রামের কৃষি শ্রমিক আব্দুল কাশেমের মিয়ার ছেলে সোনা মিয়া। তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। দরিদ্র পিতা অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করে যে টাকা আয় করতেন তা দিয়ে পরিবার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়লে, নিজের ইচ্ছে না থাকা সত্যেও ঢাকা শহরে একটি কারখানায় কাজ শুরু করেন প্রায় ৩ বছর। সেই বদ্ধ পরিবেশে থেকে মুক্তির সন্ধানে শুরু করেন ঢাকা শহরে ফেরী করে কাঁচা সবজি বিক্রি করার। সেখান থেকে কিছু অর্থ সঞ্চয় করে কিছু বাড়িতে পাঠায়। এমনি করে চলে যায় প্রায় সাত বছর। এরপর বাড়িতে এসে সঞ্চয়ের টাকা থেকে ৫০ শতাংশ জমি বন্ধক নেন এক লক্ষ টাকা দিয়ে। বন্ধক নিয়ে বিপদে পড়ে যান তিনি। কারণ জমিটিতে বর্ষা মৌসুমে পানি জামে থাকে এবং এক পাশে আবার গাছের ছায়া পরে।
এমনি একটি জমিতে কি ধরনের ধান করবে সে সিদ্ধান্ত নিতে নিতে তখন ধানের জালা বোনা সময় পার হয়ে যায়। সেই সময় প্রতিবেশি কৃষক মন্নাছ মিয়ার বাড়ির সামনে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বারসিক’র সহায়তা কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে স্থানীয় জাতের ধান জাত গবেষণা প্লটের জন্য ২২ ধরনে ধান রোপণ করা হয়েছিল। সেই গবেষণা প্লটের থেকে আগ্রহ ভরে নিয়ে আসেন ২২ ধরনের ধানের চারা। সেই চারা তিনি জমিতে রোপণ করে। প্রতিটি জাত কম বেশি ফলন দেয় কিন্তু সেখান থেকে সোনা মিয়া পেয়ে যান তার নিচু জমির উপযোগি জাতটি, যার নাম মুশুরী পাইজং। ধান গাছটি নিচু জমিতে হয় এবং জমে থাকা পানির সাথে লড়াই করে খুব সহজে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। সোনা মিয়া সবগুলো ধান এক সাথে করে খাবারের জন্য চাল করে নেয়। মুশুরী পাইজাম ধানগুলো বীজের জন্য সংগ্রহ করেন।
চলতি আমন মৌসুমে তিনি ৫০ শতাংশ জমিতে চাষ করেন মুশুরী পাইজাম। নিচু অবহেলিত স্যাঁতস্যাঁতে জমির ধানগুলো গ্রামের বাজার থেকে কেনা ধানগুলোকে ছাড়িয়ে ভালো ফলন দেখে স্থানীয় কৃষকদের নজর কাড়ে। কাঠা প্রতি ফলন পায় প্রায় পাঁচ মণ। এ সম্পর্কে সোনা মিয়া বলেন, ‘মুশুরী পাইজাম ধানটি আমার নিচু জমিতে ভালো ফলন পেয়েছি। ধানটি ওজন ভালো, ফলন ভালো হওয়ায় দাম একটু কম পেলেও ক্ষতি হয়না।’ তিনি মুশুরী পাইজামের বীজ সংগ্রহ করেছেন আগামী মৌসুমে চাষ করার জন্য। পাশাপাশি গ্রামে যাদের নিচু জমি রয়েছে এবং পতিত পড়ে আছে সেই সব আগ্রহী কৃষকের মাঝে এই বীজ বিতরণ করবেন বলে সোনা মিয়া জানান।
সোনা মিয়ার মতো আমতলা ইউনিয়নের অনেক গ্রামে এখন বৈচিত্র্যময় ধান চাষ করছেন। এসব ধানগুলোর মধ্যে রয়েছে সুবাশ, কাবন্দুলান, বাশমতি, বাদশা ভোগ ইত্যাদি। বেশি ফলনের আশায় বাজারের কেনা বীজ রোপণ করে হতাশ কৃষকদের মাঝে স্থানীয় জাতগুলো চাষ করার আগ্রহ বাড়ছে সম্প্রতি। এ সম্পর্কে গ্রামের স্থানীয় জাতের ধান চাষী কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের গ্রামের সব জায়গা সমান না। নদীর চর, মাঠের জমি, পাশাপাশি ডুবা জমি রয়েছে। আমরা আমাদের জমির ধরন অনুযায়ী জাতগুলো সংরক্ষণে কাজ করছি। অনেক জাতের ধান চাষ করায় আগের তুলনায় পোকার আক্রমণ কমছে।’
দীর্ঘ সময় ঢাকায় থাকলেও সোনা মিয়া আর ঢাকায় যেতে চান না। বাড়িতে থেকেই নিজের বাড়ির প্রতিটি জায়গা কাজে লাগিয়ে পরিবারের চালাতে চান। চলতি মৌসুমে ধান চাষের পাশাপাশি চাষ করেছেন মৌসুমী সবজি, সিম, লাউ, ডাটা, কুমড়া ইত্যাদি। পালন করছেন হাঁস, মুরগি ও গরু, যা দিয়ে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হচ্ছে এবং অর্থনৈতিকভাবেও তিনি সাবলম্বী হচ্ছেন।