সুরের মুর্ছনায় বর্ষা বরণ
মানিকগঞ্জ থেকে পংকজ পাল
বর্ষা বাংলাদেশের আনন্দ-বেদনার এক ঋতু। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দহন শেষে বর্ষা আসে প্রকৃতির আর্শীবাদ হয়ে। একটানা বর্ষণের পর পৃথিবীতে জেগে ওঠে প্রাণের স্পন্দন। বাংলার নিসর্গ লোক সজীব হয়ে ওঠে। বর্ষার আগমনে তাই বাংলার প্রকৃতির রূপও পাল্টে যায়। বৃষ্টির ছোয়া পেয়ে গ্রীষ্মের বিবর্ণ প্রকৃতি হয়ে ওঠে কোমল আর সজীব।
এই সজীবতাকে আরও প্রাণবন্ত করতে সম্প্রতি মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওরে আয়োজি হয়েছে দিনব্যাপী “বর্ষাবরণ ও ফুল উৎসব”। “আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ে/টাপুর টুপুর বর্ষা ঝরে/বৃষ্টি পড়ে গাছের ডালে/ মাঠে ঘাটে বাড়ির চালে।” এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ, কবি-লেখক, ইলেক্ট্রনিক ও প্রেস মিডিয়ার ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ, বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ, যুব জলবায়ু ও স্টুডেন্টস্ সলিডারিটি টিমের সদস্যরা বর্ষা বরণে মিলিত হন। বর্ষাকে ঋতুকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে বরণ অনুষ্ঠানে কবি ও প্রভাষক দেলোয়ার রহমান খান তাই বলে উঠেন, “ঋতুর গণনা হিসেবে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। কিন্তু বর্ষার বৃষ্টি শুরু হয় বৈশাখ থেকে, চলে ভাদ্র-আশ্বিন মাস পর্যন্ত। সেই হিসেবে বর্ষা বাংলাদেশের দীর্ঘতম ঋতু। বর্ষার আগমনে তৃপ্তি পৃথিবী সিক্ত-শীতল হয়ে যায়। মানুষ-জীবজন্তু, প্রাণ-প্রকৃতি সব শান্তির পরশে হাফ ছেড়ে বাঁচে।” তিনি আরও বলেন, “নদী-নালা, খাল-বিল, মাঠ-ঘাট পানিতে ভরপুর হয়ে যায়। নানা ধরনের ফুলে বিমোহিত করে মন। গাছপালা নতুনপত্র পল্লবে ভরে যায়, উর্বর হয়ে ওঠে ফসলের ক্ষেত। ছেলে-মেয়েরা বর্ষার জলে নৌকা ভাসায়, মাছ ধরার মেতে ওঠে। বর্ষা- সুখ ও আনন্দের বার্তা নিয়ে বাংলায় আসে।”
সাংস্কৃতিক কর্মী শক্তিপদ করের কণ্ঠেও বর্ষা ঋতুর জয়গান। তিনি বলেন, “বর্ষায় প্রকৃতি অন্যরকম হয়ে যায়। আকাশে ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা। দুই তিন দিন সূর্যের মুখ দেখা যায় না। শোনা যায় মেঘের গর্জন। বিশ্বকবির ভাষায়- ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’ নানারকম ফুল ও ফল পাওয়া যায়। বর্ষায় পল্লীর দৃশ্য সত্যি অপূর্ব।” নতুন প্রজন্মের কাছে বর্ষা ঋতু একইরূপে ধরা পড়ে। তাই তো অনার্স পড়–য়া শিক্ষার্থী এনামুল ইসলাম সজল বলেন, “বর্তমান অস্থির সময়ে স্বস্তির পরশ ‘বর্ষাবরণ ও ফুল উৎসব’ অনুষ্ঠানটি। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার জন্য এ ধরনের আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের চর্চার মাধ্যমে আমাদের মনের বিকাশ ঘটবে।”
আলোচনাসভায় বর্ষা ঋতুর উপকারিতা যেমন স্মরণ করা হয় ঠিক তেমনি অতি বর্ষায় অকাল বন্যা ও দরিদ্র মানুষের শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে।
বর্ষা ঋতুকে বরণ করার জন্য আয়োজকরা শুধু আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। তাই তো গান বাজনা, কবিতা আবৃত্তিসহ নানান আঙ্গিকে এই ঋতুকে বরণ করে নেন আয়োজকরা। ঋতুকে গান পরিবেশনের মাধ্যমে বরণ করে নেন সুশীল কুমার সাহা, বাউল আক্কাছ, শর্মিলা, রেজাউল করিম রেজা, প্রিয়তি ও নিশি। তাদের সঙ্গীতের সুর ও বাদ্যের মুর্ছনায় পুরো পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠে।উপস্থিত সবাই অধীর মনোযোগে তা উপভোগ করেছেন। “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, ‘নব আনন্দে জাগো’ ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়’, ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে’ ‘মন মাঝি’ ‘আকাশ এত মেঘলা-যেও নাকো একলা’- প্রভৃতি গানের সুরের মুর্ছনায় মুর্ছিত হয়েছিলেন উপস্থিত দর্শনার্থীগণ।
ঋতুকে বরণ করে নেওয়ার মাধ্যমে এই ঋতুতে পাওয়া যায় এমন ফুল ও ফলের প্রদর্শনীও আয়োজন করেন আয়োজকরা। আগত অতিথি ও বিভিন্ন পেশার ও শ্রেণীর মানুষেরা সুরের মুর্ছনায় মোহিত হওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই তারা বর্ষা ঋতুতে প্রকৃতিকে অপরূপ রূপে সজ্জিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক ফুলের সাথে পরিচিত হন। জুই, টগর, বেলি, চাপা, কদম, হাসনাহেনা, গন্ধরাজ, কাঞ্চন, সন্ধা মালতি, জবা, শিউলী, দোলন চাপা, নয়ন তারা, পানা ফুল, বন গোলাপ, লাউফুল, ধুন্দলফুল, কুমড়া ফুল, তেলাকুচ ফুল, কলাবতী ফুল, ঘাসফুল, ঢেড়শ ফুল, শিম ফুল, বেগুন ফুল, পেঁপে ফুল, ধুতুরা ফুল, বন ফুলসহ নানা ধরনের ফুলের সম্মিলন তাদেরকে বিমোহিত করে। বর্ষার এমন আয়োজন দেখে বর্ষা ঋতুর প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা!
আমাদের ফুল আর ঋতু আমাদের গৌরবোজ্জল ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কালের বিবর্তনে আজ সব হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকাশে, প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর ভালোবাসা বৃদ্ধিতে এ অনুষ্ঠান সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। দেশীয় ফুল, দেশীয় গান, দেশীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণে অনুপ্রেরণা যোগাবে। সকলের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণই এ ধরনের কর্মসূচির গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।