অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনে শংকরী রানীর অবদান
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
যুগে যুগে নারীরা প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছেন প্রাণবৈচিত্র্য এবং আমাদের খাদ্য ভান্ডার। সেই সাথে প্রাণবৈচিত্র্যের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনায় সমৃদ্ধ করেছেন নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। এক সময় উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের প্রতিটি কৃষি বাড়ীাই ছিল এক একটি খামার। স্থানীয় পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের রুপ/আকার পরিবর্তন করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ একটি কৃষি বাড়ী/খামার তৈরি করতন। কিন্তু,আধুনিক কৃষির প্রচলন, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং বাণিজ্যিক চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ বাংলাদেশের উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের অসংখ্য কৃষি পরিবারের এই প্রতিবেশিক বন্ধন বিগত এক দশক ধরে চরমভাবে ক্ষত-বিক্ষত।
এমনও শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে উপকূলীয় কৃষি পরিবারের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন অনেক কৃষি পরিবার। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কুলতলী গ্রামের শংকরী রানীর (৪৫) প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ কৃষি বাড়ী তেমনই একটি কৃষি পরিবার। সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থাপণার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভের মুখ দেখেছেন শংকরী রানী। তিনি বলেন, “আমি প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকার সবজি বিক্রি করছি। আমার বাড়ি থেকে পাড়া প্রতিবেশী এসব সবজি কিনে নিয়ে যায়। আমার সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক কোন সার বিষ দেইনে। এজন্য চাহিদা বেশি। এর মাধ্যমে আমার দুই মেয়ের পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারি।’
স্বামী ও দুই সন্তান সহ চার সদস্যের ছোট্ট সংসার শংকরী রানীর। স্বামী প্রশান্ত মন্ডল (৪৯) পেশায় ভ্যানচালক। বড় মেয়ে সুস্মিতা বালা ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে চাকরির খোজে ব্যস্ত এবং ছোট মেয়ে সংগীতা বালা জেলা শহরে অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী। স্বামী দিনের অধিকাংশ সময় বাইরে ভ্যান চালানোর কাজ করেন। যদিও স্বামী ও সন্তানদের সহযোগিতায় কৃষি বাড়ির সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে তার নিজ হাতেই। তার এই কৃষি উদ্যোগকে আরো একধাপ বাড়িয়ে দেয় বারসিক পরিবার।
২০২১ সালে অক্টোবর মাসে নেটজ পার্টনারশিপ ফর ডিভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় বারসিক’র বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কুলতলী গ্রামে ধুন্দল সিএসও দলে যুক্ত হয়। যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক আলোচনায় সভায় অংশগ্রহণ করে আসছেন। কিছুদিন পরে বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে উৎপাদনশীল সম্পদ হিসাবে কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য একটি মটর, একটি কদবেল ও পেয়ারার চারা, কিছু বীজ ও একটি ছাগল ও দুটি মুরগি সহযোগিতা পান। বারসিক থেকে জলবায়ু সহনশীল কৃষি চর্চা গ্রহণের মাধ্যমে এবং নিয়মিত সাপ্তাহিক আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহযোগিতার এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন সমৃদ্ধশীল একটি কৃষি খামার।
শংকরী রানী মাত্র ১৫ শতক বসতভিটায় বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষাবাদসহ প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করেন। ফলজ ও বনজ উদ্ভিদবৈচিত্র্য হিসেবে আম জাম, কলা, নারকেল, পেয়ারা, সবেদা, লেবু, তাল, খেজুর, রেইনট্রি, খদি, নিম, কদবেল, পাতিলেবু, আঁশফল, কমলালেবু, ডালিম, কাঁঠাল, পেঁপে, ঔষধি উদ্ভিদবৈচিত্র্য হিসেবে বাগানে রয়েছে, কৃষ্ণ তুলসী, রাধা তুলসী, মাধবীলতা, রঙ্গন, নয়নতারা, পাথরকুচি, দূর্বাঘাস, মেহেদী, গাদাফুল স্থানীয় ফসল বৈচিত্র্য হিসেবে লালশাক, ডাটাশাক, পালংশাক, সীম, বরবটি, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, ঢেড়স, চালকুমড়া, উচ্ছে, করল্লা, বেগুন, টমেটো, ওল, কচুরমুখী, আদা, হলুদ, পুইশাক, সরিষা, মরিচ/ঝাল, আলু, ওলকপি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, মূলা, বড় আলু. মানকচু ইত্যাদি চাষাবাদ ও সংরক্ষণ ও প্রাণীসম্পদ হিসেবে ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করেন। তাছাড়া, নিজের মিষ্টি পানির পুকুরে সারাবছর স্থানীয় মৎস্যবৈচিত্র্য কৈ, শিং, মাগুর, মলা, শোল, ঢেলা, চ্যাং, ব্যাদলা, পুটি, মরুল্য, রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, টেংরা, চিংড়ী ইত্যাদি চাষাবাদ ও সংরক্ষণ করেন। শংকরী রানী এ বিষয়ে জানান, ‘আমার বসতভিটায় নানা ধরনের ফসল চাষাবাদ করি, বাজার থেকে খুব বেশি সবজি কেনা লাগে না।” পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আত্মীয় ও প্রতিবেশীর মাঝে বিনামুল্যে বিনিময় ও বিক্রি করে কিছু টাকা সঞ্চয় করেন। যা কিনা সঞ্চয় জমা সহ মেয়েদের পড়ালেখার খরচসহ পারিবারিক কাজে ব্যয় করেন।
বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের ধুন্দল গ্রুপের সভানেত্রী হিসেবে শংকরী রানী স্থানীয়এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের সরকারী ও বেসরকারী সেবা আদায়ের জন্য স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ সমন্বয় করেন। তিনি বারসিক থেকে একটি মটর সহযোগিতা পাওয়াতে তার কৃষি কাজকে আরো বেশি সহজ করেছেন। ফসল উৎপাদনে পানি সেচ ব্যবস্থাপনার জন্য মটরটি কাজে লাগিয়ে পূর্বের চেয়ে তুলনামূলক বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারছেন। তিনি বলেন, “বারসিক আমাকে সহযোগিতা করায় আমি লবণাক্ত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বা পরিবেশের সাথে টিকতে পারে এমন সব কৃষি কাজ করছি।’ তার বাড়িতে দেখা মেলে, ঔষধি উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের প্লট, কুড়িয়ে পাওয়া শাকের প্লট, বস্তা পদ্ধতিতে সবজী চাষ, মাচায় ঝুলছে সবজি, স্থানীয় প্রজাতির বীজ ব্যাংক, পরিবেশবান্ধব চুলা ও বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ বৃক্ষ।
প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ শংকরী রানীর কৃষি পুষ্টি কানন উপকূলসহ বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষিঐতিহ্য,অস্তিত্ব, সংস্কৃতি এবং স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রার দিকনির্দেশনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা ও অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী শংকরী রানী অবদান সকলের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।