জাল, জলা ও জেলেদের জীবন

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
নদীর পাড়ে উঁচু উঁচু বাঁশের মাচা, তাতে ছড়ানো আছে ছোট বড় পুঁটি মাছ। বাড়ির উঠানের একপাশে সাজিয়ে রাখা আছে বড় বড় মটকা (মাটির হাঁড়ি)। গ্রামে ঢোকার সময় বা রাস্তার দুপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পথে বাতাসের ঝাপটায় নাকে লাগে হালকা একটা গন্ধ। এই গন্ধে হয়তো এক শ্রেণির মানুষ নাক সিঁটকায়। তবে এই গন্ধ বাতাসে না ভাসলে কিছু মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে যাবে। হ্যাঁ, আমাদের নেত্রকোণা অঞ্চলের বিশেষ একটা খাবার ‘হিদল’ শুটকির কথাই বলছি। যা জেলে সম্প্রদায়ের মানুষেরা তৈরি ও প্রক্রিয়াজাত করেন।
আটপাড়া উপজেলার শুনুই ইউনিয়নের একটি গ্রাম গোয়াতলা। বৌলাই নদীর তীর ঘেঁষে এই গ্রামটি অবস্থিত। ৪২টি পরিবারের বসবাস এই গ্রামে। এখানকার সবাই মৎসজীবী। কেউ মাছ ধরেন, কেউ মাছের ব্যবসা করেন। কেউ আবার মাছের আড়তে শুটকি/হিদল তৈরির কাজ করেন।


গোয়াতলা গ্রামের জেলে পরিবারগুলোর জীবন জীবিকা একটু ভিন্ন রকম। স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন গ্রামের যে চিত্র দেখা যায় তা এখানে চোখে পড়েনা। কৃষি অধ্যষিত গ্রামগুলোতে চোখে পড়ে ধান তোলা, সংরক্ষণ নিয়ে কৃষাণীদের ব্যস্ততা। কৃষকগণ ধান কাটছেন। কিন্তু এখানকার নারীরা মাছ কাটায় ব্যস্ত সময় পার করেন। আর পুরুষেরা জাল বুনছেন বা রোদে শুকাচ্ছেন। কেউ আবার জাল নিয়ে মাছ ধরতে বের হচ্ছেন। তবে এখানে যে কৃষিকাজ একেবারেই হয়না, তা কিন্তু নয়। একটু স্বচ্ছল জেলেগণ জমি কিনেছেন এবং সেখানে ধান চাষ করেন। তবে সেটা মৌসুমভিত্তিক। আর মাছের দাওয়া চলে সারাবছর।


মাছ ধরার জন্য প্রতিটি জেলে পরিবারের আছে নিজস্ব নৌকা। এই নৌকার সাহায্যেই তাঁরা বৌলাই, রাজাখালি, মগড়া নদী থেকে মাছ সংগ্রহ করেন। এছাড়া এলাকার বিভিন্ন জলাশয় থেকেও মাছ সংগ্রহ করেন। বৌলাই নদীতে কখনো লিজ হয়না তাই সব সময় তাঁরা মাছ ধরতে পারেন। তাছাড়া শুষ্ক মৌসুমেও বৌলাই নদীতে পানি থাকে। আশ্বিন-কার্ত্তিক মাসে সবচেয়ে বেশি মাছ পাওয়া যায়। অঘ্রাণ-পৌষ মাসে পুঁটি মাছ বেশি ধরা পড়ে। এই সময় জেলেরা আটপাড়া অঞ্চল ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার ডোবা, বিল ও নীচু জায়গা থেকে অন্যান্য মাছের পাশাপাশি পুঁটি মাছ সংগ্রহ করে আনেন। সংগৃহীত মাছ দিয়েই ‘হিদল’ তৈরি করেন তাঁরা।


পরিবার ও গ্রামের নারীরা সকলে মিলে মাছ কাটেন। বিষয়টা এরকম হয় যে, কোনো জেলে পুঁটি মাছ নিয়ে এলে তাঁর পরিবার ও অন্যান্য পরিবারের নারী, কিশোরীরা মিলে মাছ কেটে দেয়। এখানে যারা মাছ কাটেন তারা এর বিনিময়ে মজুরি পান। আর বাড়তি পাওনা হিসেবে মাছের তেলটুকু তাঁরা নিয়ে যান। এই তেল প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করেন। বেশ কয়েক বছর আগেও মাছের অন্যান্য এলাকা যেমন বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ এ বিক্রি করা যেতো। এখন এই তেল নিজের গ্রামেই তাঁরা বিক্রি করেন। প্রতি কেজি তেল একশত পঞ্চাশ টাকা দরে বিক্রি করেন। বিক্রির পর বাকি তেলটুকু নিজেরা ব্যবহার করেন। মাছের তেল দিয়ে বিভিন্ন রান্নাও করা যায়। তাছাড় ‘হিদল’ তৈরি করতে এই তেলের প্রয়োজন হয়।


‘হিদল’ তৈরির প্রক্রিয়া যদিও কষ্টকর তবুও এর চাহিদা আছে প্রচুর। এক কেজি ভালো মানের হিদল প্রায় এক হাজার থেকে বারো’শ টাকায় বিক্রি করতে পারেন। এই হিদল নেত্রকোণা ছাড়াও মোহনগঞ্জ, ময়মনসিংহ এমনকি ঢাকায় বিক্রি হয়। গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন জেলেদের আটপাড়া বাজারে মাছের আড়ৎ আছে। এখান থেকেই পাইকারি দরে হিদল বিক্রি করেন।
জেলেরা সারাবছরই বিভিন্ন নদীতে মাছ ধরেন। এসব মাছের মধ্যে রুই, কাতল, বোয়াল, মৃগেল, চিতল, ঘাঘট, কালবাউশ, পুঁটি, টেংরা, চিকরা, খইলসা, পাবদা, বাতাই, চিংড়ি উল্লেখযোগ্য। এসব মাছ বাজারে বা পাইকারের কাছে বিক্রি করে বেশ ভালো উপার্জন হয় তাঁদের। এই উপার্জনেই চলে তাঁদের সংসার।


ঝাপ জাল, ঝড়া জাল, মলাই জাল, শিক জাল, টাক জাল, লড়ি জাল ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের জালের সাহায্যে জেলেরা মাছ ধরেন। বিভিন্ন ধরণের মাছ ধরার জালও ভিন্ন রকমের। যেমন শিক জাল দিয়ে পাবদা, ঘুইঙগা মাছ আর ঝাপ জাল দিয়ে বোয়াল, ঘাঘট মাছ ধরা হয়। জালগুলো অনেক সময় তাঁরা নিজেরাই তৈরি করেন। কোনো কোনো সময় আবার কিনে আনেন। কেনা জালগুলোকে আবার কিছু মেরামত করে নিতে হয়। গ্রামের কয়েকজন নারী এই জাল মেরামতের কাজ করেন। বিনিময়ে তারা জাল মালিকের কাছ থেকে মজুরি পান।
করোনাকালীন সময়ে এই জেলেপাড়ার বাসিন্দাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। লকডাউন থাকার সময় গাড়ি চলতোনা। তাই জেলেরা গাড়ির সাহায্যে মাছ বিক্রি করতে দূরে কোথাও বিক্রি করতে পারেনি। যে সকল জেলেরা মাছের ব্যবসা করতেন, তাঁরা মাছ কেনার টাকা দিয়ে কেউ জমি কেউ আবার গরু কিনেছেন। জমানো টাকা অযথা নষ্ট না করে তাঁরা ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ কিনেছেন। এই সম্পদ এখন তাঁদের পরিবারের বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।


এই গ্রামের পুরুষরা যেমন সারাদিন মাছ ধরেন, নারীরাও তেমনি বসে নেই। পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে তাঁরা জাল বোনা, মাছ কাটা ইত্যাদির কাজ করে থাকেন। এছাড়া সাংসারিক অন্যান্য কাজতো আছেই। আবার যাদের জমি আছে তাঁরা ধান তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করেন। কারো বসত ভিটার খোলা জায়গায় সব্জি চাষও করতে দেখা যায়।
গোয়াতলা গ্রামের প্রতিটি পরিবারের শিশুরা স্কুলগামী। বারসিক’র সহযোগিতায় এখানে শিশু বিকাশ কেন্দ্র পরিচালনা ও শিক্ষা সচেতনতা বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এই সকল কার্যক্রম শিক্ষা বিষয়ে তাঁদের সচেতন করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এখানকার কেউ যদিও উচ্চ শিক্ষায় এখনো শিক্ষিত হতে পারেনি তবুও অনেকে স্কুল পেরিয়ে কলেজের গ-ি ছুঁয়েছে। কেউ আবার স্কুলের পড়া শেষ করে মাছ ধরা পেশায় যুক্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য সমস্যাায় এখন কোনো নারী বা শিশুর ভুগতে হয়না। স্থানীয় বাজারে হাসপাতাল আছে। সেখানেই তাঁরা প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তাছাড়া খুব বেশি বাড়াবাড়ি হলে জেলা শহরে গিয়েও তাঁরা চিকিৎসা করতে পারেন। এছাড়া গৃহস্থালী/অচাষকৃত উপকরণের সাহায্যেও পরিবারের সদস্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা হয়।
আধুনিকতার ছোঁয়া আছে এই গ্রামে। গ্রামে এখন বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। তাই প্রতিটি বাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে। আছে টেলিভিশন, ডিশ সংযোগ, ইন্টারনেট সুবিধা। নারীরা কাজের ফাঁকে টেলিভিশন দেখে দেশ বিদেশের খবর জানতে পারে। এছাড়া কিশোরীদের বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান আর শিশুদের বিনোদনের জন্য একমাত্র উপায় হলো টেলিভিশন। ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার কাজ করতে পারে।


অভাব নামক কোনো অদৃশ্য শত্রু এই জেলে পরিবারগুলোতে এখন আর নেই। বর্তমান সময়ে যদিও মাছের বৈচিত্র্যতা কিছুটা কমেছে, তবে পরিমানে বেশি পাওয়া যায়। প্রতিদিন মাছ ধরা আর বিক্রি করে তাঁদের পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে। দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও এসেছে গতিশীলতা। একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে মৌলিক চাহিদার প্রয়োজন তার সবক’টিই তাঁরা এখন পূরণ করতে পারেন। তাঁদের আছে জাল আর জলায় নামার অধিকার। নিজস্ব আদি পুরুষের পেশায় যুক্ত থেকে তাঁরা টিকে আছেন নিজেদের মতো করে। সমাজের উঁচু শ্রেণির পেশাজীবীদের সাথে সমানতালে এগিয়ে যাওয়ার সাহস তাঁরা অর্জন করেছেন। তাঁদের জীবন এখন থেমে থাকার নয়, শুধুই চলার।

happy wheels 2

Comments