পিছিয়ে পড়া নারীদের অনুপ্রেরণাকারী পারভীন বেগম
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
মানুষের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে তার পরিবার থেকে। মানুষের পরিবার পরিচালনার দক্ষতা নিজের ভিতরে নেতৃত্বকে জাগ্রত করে যা পরবর্তীতে সমাজে নেতৃত্ব দানে সক্ষমতা তৈরি করে। কিন্তু আমাদের সমাজে সামাজিক বৈষম্যের শিকার পরিবারের নারীরা। সামাজিকভাবে আমাদের সমাজে অধিকাংশ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পরিবার পরিচালনা দায়িত্ব পালন করে থাকে। পরিবারের আর্থিক লেনদেন দায়িত্ব থাকে পুরুষ সদস্যরা। ফলে পরিবারের বাইরে প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ, বাইরের জগৎ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে বড় হয়। পরিবারের নারী সদস্যদের পথচলা শুরু হয় এটা করো না, এ দিকে যেও না, এমন করে কথা বলো না এমনি নানা ধরনে নিয়মের বেড়াজালের মধ্য দিয়ে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের দেশের অবস্থান পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে গেলেও আমাদের পরিবারের নারীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ অনেক পিছিয়ে আছে এখনো।
আমতলা ইউনিয়নে বিশ্বনাথপুর গ্রামের পারভীন বেগম সমাজে তৈরী বাধাগুলো ভেঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়া একজন নারী। যে নিজের জীবনের অধিকার আদায়ের চেয়ে নিজ গ্রামের প্রান্তিক নারীদের অধিকার আদায়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বাবার অকাল মৃত্যু, তিন বোন, অসুস্থ মা রয়েছে তার পরিবারে। বোনদের রেখে বিয়ে করার ইচ্ছে না থাকলেও সামাজিক কারণে বিয়ে করে খুব সাধারণ চাকরীজীবি একজনকে। বিয়ের পর স্বামীর সাথে প্রথম চুক্তিই ছিল হাটতে না পাড়া অসুস্থ বৃদ্ধি মা ও দুই বোনকে রেখে স্বামীর বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হবে না। ত৭ার স্বামী শর্তগুলো মেনে নিয়ে বিয়ে করেন।
বর্তমানে পারভীন বেগম বিশ্বনাথপুর নিজের মায়ের বাড়িতে থাকেন। জীবনের প্রয়োজনে পারভীন বেগম নানান কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। গ্রামের যে কোন বাড়িতে পারিবারের দ্বন্ধ শুরু হলে গ্রামের নারীরা ছুটে আসে পারর্ভীন বেগমের কাছে। প্রাথমিকভাবে নিজে সমস্যা মেটাতে চেষ্টা করেন তিনি। যে সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য স্থানীয় সরকার বা জেলা সদরে যেতে হয়, তিনি নিজ দায়িত্বে নিয়ে যায়। পাশাপাশি গ্রামের বাল্য বিয়ে বন্ধে কাজ করছেন নিতি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “বাল্যবিয়ে বন্ধের প্রাথমিক ধাপ আমি আমার পরিবার থেকে শুরু করেছি, আমার বাবা নেই। আমি নিজ দায়িত্বে আমার বোনদের পড়াশোনা শেষ করার পর বিয়ে দিয়েছি, এ জন্য সমাজে আমার পরিবারকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে কিন্তু আমি আমায় জায়গা থেকে সরে দাঁড়াইনি। দুই বোন ডিগ্রী পাশ করার পর বিয়ে দিয়েছি।’ পারভীন বেগমের এ সংগ্রাম গ্রামের অনেক পরিবার বাল্য বিয়ে বন্ধ করেছে।
পারভীন বেগম সমাজের অসহায় নারীদের নানাভাবে সহায়তা করেন। বিশ্বনাথপুর গ্রামের অধিকাংশ পরিবার কৃষির উপর নির্ভরশীল। গৃহবধুরা কৃষি উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকলেও ফসল বিক্রয় করে থাকে পুরুষ সদস্যরা। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে একসময় গ্রামের নারীদের একেবারে যোগাযোগ ছিল না। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় স্থানীয় সরকার বা অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারী সেবা প্রতিষ্ঠানে সেবাগুলো থেকে গ্রামের মানুষ বঞ্চিত। এ অবস্থায় পারভীন বেগম নিজ উদ্যোগে বারসিক’র সহায়তায় নিজ গ্রামে বিশ্বনাথপুর কৃষাণী সংগঠন নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছে। নিজ বাড়িতে তৈরি করে কৃষি তথ্যকেন্দ্র। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করে সেবা প্রাপ্তি নিজ এলাকার মানুষদের যুক্ত করার কাজ শুরু করেন। একসময় সেবা থেকে বঞ্চিত বিশ্বনাথপুর গ্রাম প্রায় সেবা প্রাপ্তি উপযোগি প্রতিটি পরিবার বর্তমানে সেবা পাচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের যোগাযোগ করে গ্রামের বিধবা, প্রবীণ ব্যক্তিদের ভাতা প্রাপ্তির কার্ড পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে তিনি।
পারভীন বেগম সামাজিক কাজের পাশাপাশি সীমিত জায়গায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেন। পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণে তিনি বাড়ির আঙ্গিনায় ও শীত মৌসুমে নদীর চরে লাউ, সরিষা, মরিচ, ধনিয়া, মিষ্টি আলু চাষ করেন। জমি প্রস্তুত, বপন থেকে শুরু করে ফসল তুলার কাজ নিজেই করেন। বাড়ির পাশে কিছুটা রোদ কম থাকায় হলুদ চাষ করেন তিনি। পারভীন বেগমের এ সবজি চাষের আগ্রহ দেখে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা গতবছর ২০ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ চাষের প্রয়োজনীয় বীজ সহায়তা দিয়েছেন। ভালো ফলন হওয়ায় গ্রামের অনেক কৃষক আগামী বছর পেঁয়াজ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। কৃষি অফিসের প্রয়োজনীয় সেবা প্রাপ্তিতে সহায়তা করছে বারসিক।
অন্যদিকে পারভীন বেগম অচাষকৃত উদ্ভিদ ব্যবহার করেন খাদ্য হিসেবে, ওষুধ হিসেবে। নিজের আগ্রহে পরিবার ও বাড়ির প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নানা ধরনে ঔষধি ব্যবহার ও সংরক্ষণ করতে শিখেছেন। তাই পরিবারের সদস্যদের প্রাথমিক চিকিৎসায় তিনি সারাবছর বাড়ির চারপাশ থেকে ভিন্ন গাছ গাছালি, লতা পাতা দিয়ে ঔষধ তৈরি করে ব্যবহার করেন। তিনি বাড়িতে তুলসী, আমলকি, হরিতকি গাছ রোপল করেছেন শুধু ঔষধ হিসেব ব্যবহার করার জন্য। পারভীন বেগম প্রাণী সম্পদও পালন করেন। তিনি সারাবছর বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গরু পালন করেন। রান্না করার জন্য তিনি পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহার করেন। এতে করে তাঁর জ¦ালানি যেমন কম লাগে তেমনিভাবে রান্নায় ধোঁয়া কম হয় বলে নানান স্বাস্থ্যগত সমস্যা থেকে রক্ষা পান বলে তিনি জানান।