মানিকগঞ্জ অনুষ্ঠিত হলো প্রথম নদী সম্মেলন
মানিকগঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার:
“নদী বাঁচায় প্রাণ-প্রকৃতি, নদীর প্রাণ রক্ষা চাই” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে নদীর অবাধ প্রবাহ অব্যাহত রাখা, দখল ও দূষণ রোধ করা এবং নদীর জীবন রক্ষায় নতুন প্রজন্মের আরো বেশি অংশগ্রহণের প্রত্যয়ে অনুষ্ঠিত হলো মানিকগঞ্জ নদী সম্মেলন- ২০১৭। মানিকগঞ্জ জেলার ১১ টি (ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা, পদ্মা, যমুনা, ইছামতি, মন্দা, ক্ষিরাই, মনলোকখালী, গাজীখালি, ভূবনেশ্বর, কান্তাবতী) নদীর প্রতীকী প্রদর্শণী উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু হয়। জাতীয় সংগীত গাওয়ার পর নদীর প্রতীকী প্রদর্শণী উদ্বোধন করেন গাজী কামরুল হুদা সেলিম, মেয়র, মানিকগঞ্জ পৌরসভা।
প্রথমেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন বারসিক এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায়। তিনি বলেন, এই নদী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আমরা নদী বাঁচাতে চাই। সরকার তিস্তা চুক্তি করতে যাচ্ছে। প্রাণ-প্রকৃতি, জীবন-জীবিকা ও পেশাজীবী সম্প্রদায়ের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নদী সংশ্লিষ্ট যাদের জীবন, সংস্কৃতি তা বাঁচাতে, টিকিয়ে রাখতে নদী বাঁচাতে হবে। এ বছর পানি দিবসের অন্যতম বিষয় ছিল ‘নদী খাল খনন কর, বাংলাদেশ রক্ষা কর।’ আমরাও চাই নদী খনন করা হোক। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আমরা নদী খননের জন্য একমত ও একাত্মতা ঘোষণা করবো।”
সমকাল সুহৃদ সমাবেশ, মানিকগঞ্জ এর আহবায়ক শাহীনুর রহমান বলেন, “মানিকগঞ্জে প্রথম নদী সম্মেলন হচ্ছে। আমরা সকলে গ্রামে বড় হয়েছি, নদীতে গোসল করেছি- অনেক আনন্দ লাগতো। কিন্তু আমাদের ছেলে-মেয়েরা নদীতে গোসল করতে পারে না। বর্তমানে মানিকগঞ্জ এর ০২টি নদীর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে নদীর যে প্রদর্শনী দেখানো হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে একমাত্র পদ্মা ছাড়া অন্য কোন নদীতে গোসল করার মত পানি নাই।” তিনি আরো বলেন, “পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো জোর পূর্বক নষ্ট করা হচ্ছে। নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। জেলে সম্প্রদায় মাছ ধরতে পারছে না। নৌকা বাইচ হারিয়ে যাচ্ছে। জেলেদের জীবন-জীবিকা নদী কেন্দ্রিক। তারা অন্য পেশায় গিয়ে জীবন চালাতে পারছে না। ইন্ডাষ্ট্রি মালিক নদী দূষণ করছে নদীতে বজ্র্য ফেলে। নদীতে ট্রাক চলে, বাড়ি ঘর নির্মান হচ্ছে। নদী খননের নামে অনিয়ম, মাটি বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতাচ্ছে। অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছে একটি মহল। আমরা কিছুই করতে পারি না। আমরা এই ধরণের সমাজ ব্যবস্থা চাই না। নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবন ও পেশাকে রক্ষা করতে হলে নদীকে বাঁচাতে হবে। আমরা যখন নদী বাঁচাও আন্দোলন করি তখন নদীর তীরের বা পাশের লোকজন আসলে আন্দোলন সফল হবে। আমরা তাদের আহবান জানাচ্ছি। প্রেসক্লাব মিডিয়ায়, পত্রিকায় সংবাদ প্রচার-প্রকাশের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে থাকে। আসুন আমরা মানিকগঞ্জ বাঁচাই, নদী বাঁচাই।”
সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রেসক্লাব ও সদস্য ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি, মানিকগঞ্জ জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, “আমরা এর আগে ছোট ছোট করে অনেক প্রোগ্রাম করেছি। আমরা বড় আন্দোলনের দিকে যাচ্ছি। ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও কমিটি করা হয়েছে। প্রতিটি নদীর জন্য কমিটি করতে হবে। যে পর্যন্ত নদী খনন করা না হয় সে পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। এই আন্দোলনে সবাইকে আহবান জানাচ্ছি।”
বায়রা কৃষক সংগঠন এর সাধারণ সম্পাদক ঈমান আলী বলেন “কৃষকের জীবন বাঁচাতে হলে ধলেশ্বরী নদী খনন করতে হবে। নদীর পানি হারিয়ে যাচ্ছে কারণ নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পানির জন্য বায়রা, সিংগাইর উপজেলার কৃষক হতাশ হয়েছে। কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে। পানি না থাকলে কৃষি বাঁচবে না, কৃষকও বাঁচবে না। এই সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারী ভাবে ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখ খনন করার দাবি জানাচ্ছি।”
মাছরাঙ্গা টিভি’র মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি গাজী ওয়াজেদ আলম লাবু বলেন, “নদী নিয়ে সম্মেলন করতে হবে তা আমরা কেউ ভাবি নি। বাস্তবতা এটাই আজ আমাদের নদী নিয়ে সম্মেলন করতে হচ্ছে। একসময় শামুক, ঝিনুক ছিল। ঝিনুক থেকে চ’ন বানাতো। একটা পেশা বেঁচে ছিল। পাল তোলা ১ মাইলা নৌকা আজ আর নাই। বিভিন্ন পেশা হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে নদী কেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থা। আজকে এখানে এসে অনেক নদীর নাম জানতে পারলাম। অনেক নদী হারিয়ে গেছে। আমার বাঁচার জন্য নদীকে বাঁচাতে হবে। একশ্রেণীর মানুষ নিজেদের স্বার্থে নদী ধ্বংস করছে। এরজন্য আমরাই দায়ী। এর ফলও আমরাই ভোগ করছি। এই জন্যই আজকের নদী সম্মেলন। নদীর যেখানে যে গতিপথ বাঁধার সৃষ্টি করেছে তা কাটা হোক, মোহনা খনন করা হোক। আমরা নিজে বাঁচার জন্য নদী বাঁচাই এই প্রত্যাশা সকলের কাছে।”
আইরমারার জেলে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি প্রফুল্ল রাজবংশী বলেন, “আগে কৈতরা ঘাটে লঞ্চ আসতো, নব আসতো। এখন শুকনায় নৌকা পড়ে আছে। আমরা মাছ ধরতে পারিনা। পানি ছাড়া আমরা বাঁচতে পারিনা। খাল খনন করলে আমরা মাছ ধরতে পারতাম।”
কৈতরার রামচরণ পাটনী বলেন, “ছোট সময় দেখতাম সারা বছর নদীতে পানি থাকতো। আমাদের জাতি ব্যবসা নৌকা চালাতেনা। এখন গোসল করারও পানি নাই। নৌকা বাইতে পারিনা। খেয়া নাই, ব্যবসাও নাই। নদী খনন করা দরকার।”
পালড়ার মৃৎ শিল্পী পরিতোষ পাল বলেন, “নদী-নালা দরকার। মাটি-পানির সাথে আমাদের জীবনও জড়িত। মাটি আনতে পারিনা। নদী থাকা দরকার।”
সুজন, মানিকগঞ্জ এর সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন কচি বলেন, “নদী বাঁচানোর সাথে সাথে মানিকগঞ্জ শহরের যেসব পুকুর আছে তা যাতে বিলুপ্ত না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মেয়র মহোগদয়কে আহবান জানাচ্ছি। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ধলেশ্বরী নদী খননের জোর দাবি জানাচ্ছি।”
প্রেসক্লাব, মানিকগঞ্জ এর সভাপতি গোলাম সারোয়ার ছানু বলেন, “বর্তমান প্রেক্ষাপটে নদী কতটা প্রয়োজন তা উপলব্ধি করি বলেই সবাই এখানে এসেছি। এক সময় ধলেশ্বরী নদী তীব্র স্রোত ছিল শুনেছি। এখন সেই নদী বাঁচানোর জন্য আন্দোলন করছি। নদী নিয়ে আইন থাকা সত্ত্বেও আইন মানা হচ্ছে না। তাই নদী ভরাট হচ্ছে, নদীতে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। নদী রক্ষার জন্য আন্দোলন না করলে সফল হবে না। আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত আছেন তাদেও সাথে একত্মতা ঘোষনা করছি।”
স্যাক এর সভাপতি অ্যাডভোকেট দীপক কুমার ঘোষ বলেন, “২০ সেকেন্ড আমরা চোখ বন্ধ করে ভাবি নদী নেই, পানি নেই, পাখি নেই, নারী নেই। তাহলে আমাদের কেমন লাগবে? নিশ্চয় খারাপ লাগবে। তাই আমাদের নদী দরকার।” তিনি আরো বলেন, এক শ্রেণির মানুষ নদী দূষণ করছে, নদী হত্যা করতে চাচ্ছে। মানুষ হত্যা করলে ফাঁসি হয়। নদী হত্যাকারীরও ফাঁসি দরকার। নদী ধ্বংস করা মাকে হত্যার সমান। আমার নদীকে হত্যা, দূষণ এবং দখল করতে দিবো না- সে যেই হোক। আসুন নদী হত্যাকারীর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলি। নদী, মানিগঞ্জকে রক্ষা করি।”
মানিকগঞ্জ পৌরসভা সম্মনিত মেয়র গাজী কামরুল হুদা সেলিম বলেন, “আজকে মাঝি, পাটনী, পাল যাদের পেশা নদীর সাথে জড়িত তারা তাদের মনের কথা বলছেন। তাদের কথা শুনলাম। এটা বাংলাদেশের বাস্তবতা। তারা নদী বাঁচানোর কথা বলছেন। আমিও তাদের সাথে একমত। আসুন কৃষক কীভাবে বাঁচবে তার ব্যবস্থা করি। শুধু মিছিল মিটিং করে কাজ হবে না। এই আন্দোলন অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। শিকড় না থাকলে গাছ বাঁচবে না। শিকড়কে বাঁচাতে হবে। মানিকগঞ্জ শহরের উপর দিয়ে যে খাল বয়ে গেছে তা ভরাট করা হবে না। প্রবাহমান রাখা হবে।” তিনি আরো বলেন, “নদীর প্রয়োজন আছে তা বড় বড় করে বলতে হয়না। আমরা এটা বুঝি, জানি। এখানে বিভিন্ন নদী পাড়ের নেতৃবৃন্দ আছে, নদী পাড়ের মানুষ আছে। আজকেই এই আন্দোলন এখানে সীমাবদ্ধ থাকবেনা। আসুন আমরা সকলে মিলে স্বেচ্ছা শ্রমের মাধ্যমে নদী খননের কাজে নেমে পড়ি তাহলেই এটি সম্ভব। আপনাদের সব ধরণের পদক্ষেপের সাথে আমি থাকব এই প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।”
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা পরিষদ, মানিকগঞ্জ এর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট গোলাম মহীউদ্দীন বলেন, “আপনারা নদী নিয়ে সমাবেশ করছেন এটা ভাল উদ্যোগ। এখানে যারা আছে তারা অন্তত: এটা জানলো। এই নদী আন্দোলন যতই ক্ষীণ হোক নদী আন্দোলন বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ৭০ টি নদী খননের কাজ হবে। আগামী ২ মাসের মধ্যে কালিগঙ্গা খনন করা হবে। পৌরসভার মধ্যে ইটভাটা বন্ধ হয়েছে। আমরা মানিকগঞ্জের কোন ক্ষতি করবো না। এই নদী সম্মেলন সফল হোক।”
সভাপতির বক্তব্যে ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক আজহারুল ইসলাম আরজু বলেন, “পানির অপর নাম জীবন। পানিকে কেন্দ্র করেই মানিকগঞ্জের সাহিত্য-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মানিকগঞ্জের শিল্প, সংস্কৃতি এবং সাহ্যিকে পূনরুজ্জীবিত করার জন্য নদী বাঁচাও আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে হবে। আমরা সবাই মিলে ঢাকা যাবো প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করবো, স্মারকলিপি দিবো। ঢাকা প্রোগ্রামের পরে তিল্লি মুখে জনসভা করবো সবাই মিলে। আমাদেরকে নদীর প্রতিটি মোহনায় যেতে হবে। সেখানকার মানুষকে বুঝাতে হবে। আন্দোলনে যুক্ত করতে হবে। আগামী এক মাসে রোজার আগে তরা ব্রীজের নীচে মানববন্ধন করবো। মানিকগঞ্জ শহরের খাল সচল করার জন্য মেয়রকে অনুরোধ জানাই।”
মানিকগঞ্জ নদী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে উপস্থিত জনগণ কতিপয় দাবীসমূহ তুলে ধরেন-
- নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর ভরাট করা যাবে না।
- মানিকগঞ্জ শহরের উপর দিয়ে প্রবাহিত খাল সচল রাখতে হবে।
- আকিজ পার্টিকেল দূষণমুক্ত রাখা।
- নদী সংক্রান্ত সরকারী নীতিমালার পুর্ণ বাস্তবায়ন।
- অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা।
- ধলেশ্বরীর উৎসমুখ তিল্লীমুখ খনন করা।
- কালিগঙ্গা রক্ষা করা।