প্রাণের পাড়া মেলা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বাবলু জোয়ারদার
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ প্রকৃতির সাথে মিশে আছে। প্রকৃতিতে এমন কোন উপাদান নেই যা মানুষের প্রয়োজনে আসে না। অনাদর, অবহেলা, অযতেœ বেড়ে উঠেছে এ সকল প্রাণবৈচিত্র্য। এ সকল প্রাণবৈচিত্র্যের কিছু ব্যবহার করছে মানুষ খাদ্য হিসেবে, কিছু চিকিৎসার কাজে আর কিছু উপাদান অবদান রাখছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্যান্য কর্মকান্ডে। জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অপর্যাপ্ত রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যবহার, মনুষ্য বসতি বৃদ্ধি, ২০০৯ সালের প্রলয়ংকারী আইলা ও পতিত জায়গার সংকট সৃষ্টি হওয়ায় এ সকল প্রাণবৈচিত্র্য অনেকাংশে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ সকল উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে ব্যক্তি ও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চলছে নানারকম উদ্যোগ, পরিচালিত হচ্ছে নানান রকম কর্মকান্ড। গ্রাম ও জনপদের আনাচে কানাচে জন্মানো শাক, লতাপাতা ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের সমন্বয়ে শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের মানিকখালী (পূর্বপাড়া) গ্রামে এ সমস্ত উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের প্রদর্শনী উৎসব ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রতি।
বারসিক’র সহযোগিতায় মানিকখালী (পূর্বপাড়া) গ্রামের জনগোষ্টির উদ্যোগে গতকাল (১৪ মার্চ) মানিকখালী গ্রামের কাঞ্চন রানীর উঠানে অনুষ্টিত হয় কুড়িয়ে পাওয়া অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের প্রদর্শনী উৎসব। পাড়া মেলায় তেলাকুচো, আদাবরুন, গিমেশাক, মাটিফোড়া, সেনচি শাক, কলমিশাক, হেলাঞ্চ, থানকুনি, ডুমুর, দুধশাক, আমরুল, নোনাগড়গড়ে, কলার থোড়, কলার মোচা, কচুশাক, খুদকুড়ি, বাতোশাক, কাটানুটে, শাপলা, কুলফিনাড়ী, ঘুমশাক, বউনোটে, কচুরলতি, দূর্বা, শীষআকন্দ, আগাছা, ঢেপের মূল, বাকসা, তুলসি, বনমুলা, হাতিশূড়, নিমসহ ৪১ রকমের কুড়িয়ে পাওয়া শাক ও উদ্ভিদ। এ প্রদর্শনী মেলায় স্টল দেন স্থানীয় এলাকার ২১ জন নারী।
মেলায় রমজাননগর ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য মিসেস তাসমিনা বেগম, আলহাজ্ব শেখ মহসিন হোসেন, নিলকান্ত মন্ডল, বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক প্রাপ্ত কৃষাণী অল্পনা রানী মিস্ত্রী, শিক্ষক ধনঞ্জয় মন্ডলসহ প্রবীণ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন মানিকখালী গ্রামের কৃষাণ-কৃষাণী, শিক্ষার্থী, এনজিও প্রতিনিধি ও বারসিক কর্মকর্তা। বিচারকগণ ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকের সংগ্রহ করা উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, ব্যবহার, গুনাগুণ ও এর প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে জানা ও প্রদর্শনী শেষে শুরু হয় বিচারপর্ব। প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন আসমা বেগম। তিনি ৩৪ প্রকার শাক ও উদ্ভিদ প্রদর্শনী করেন এবং গুনাগুণ ও ব্যবহার সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। ২য় স্থান অধিকার করেন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী নবমিতা বৈদ্য। তিনি ৩৭ প্রকার অচাষকৃত শাক ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য প্রদর্শন করেন এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে খুবই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন। ৩য় স্থান অধিকার করেন গনেশ মন্ডল তিনি ৩২ রকমের কুড়িয়ে পাওয়া শাক ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য প্রদর্শন করেন।
মেলায় অংশগ্রহণকারী অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী নবমিতা বৈদ্য কুৃড়িয়ে পাওয়া শাকের গুনাগুণ তুলে ধরে বলেন, “গিমেশাকে ডায়াবেটিস,এ্যাকজিমা ও চুলকানি ভালো হয়, আমরুল শাক খেলে আমাশয় ভালো হয়।” আলহাজ্ব শেখ মহসিন হোসেন বলেন, “আমার জীবনে অনেক মেলা দেখেছি কিন্তু এইমেলা দেখছি প্রথম। আমরা যারা মেলায় উপস্থিত আছি তারা শাক ও উদ্ভিদের গুনাগুণ জানবো এবং অন্যদের জানাবো এবং সংরক্ষল করবো।” রমজাননগর ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য মিসেস তাসমিনা বেগম বলেন, “আজকের এ অনুষ্ঠান সকলের মাঝে এই ধরনের শাক ও উদ্ভিদের ব্যবহার, প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করবে।” সবশেষে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সমগ্র অনুষ্টানটি পরিচালনা করেন বারসিকের চম্পা রানী মল্লিক।