জলবায়ু পরিবর্তন এবং আমাদের পৃথিবী
সিলভানুস লামিন
এক
কেন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে সেই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। গবেষক, বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিজ্ঞানী নানান প্রমাণ, তথ্য, উপাত্ত দিয়ে বিশ্বের মানুষকে জলবায়ু পরিবর্তনের নেপথ্যে কারণগুলো তুলে ধরেছেন যেখানে তারা দেখিয়েছেন যে, মানুষের কার্বননির্ভর জীবন-জীবিকায় এই পরিবর্তনকে তরান্বিত করেছে। মানুষেরা ভোগবিলাসিতার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি, তেল, রাসায়নিক ব্যবহার করছেন, নতুন স্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বন উজাড় করেছেন, মুনাফার উদ্দেশ্যে বিশ্বের ভুখ-, সমুদ্র ও আকাশকে বিভিন্নভাবে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন; আরাম-আয়েশ জীবনের জন্য প্রতিনিয়ত গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে চলেছেন, যা জলবায়ুকে অতিদ্রুত গতিতে পরিবর্তন করেছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গ্রীনহাউস গ্যাস অতিনিঃসরণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এই পরিবর্তনের মাত্রা অন্য যেকোন দশকের তুলনায় বেশি। জলবায়ুর অতি সামান্য যে পরিবর্তন ইতিমধ্যে দেখা গেছে, তার প্রাথমিক নেতিবাচক প্রভাব পৃথিবীর মানুষকে অবাক করে দিয়েছে। মূলত এ কারণেই বিশ্বের ছোট থেকে বড় সব দেশের সরকারই একজোট হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের হার হ্রাসকরণে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর। উপরোন্ত, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর এসব নেতিবাচক প্রভাব হবে নানামুখী ও সুদূর প্রসারী। আইপিসিসির মতে, মানুষের কর্মকা-ের কারণে পৃথিবী যে পরিমাণ উষ্ণ হচ্ছে সেটির প্রভাব আগামী একশ’ বছরও টিকে থাকবে। এই উষ্ণতর পৃথিবী নানান ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করবে, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, জীবিকা এবং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করছে এবং ভবিষ্যতে করবে, যা এসডিজির সফল বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
দুই
বিজ্ঞানীরা ৬০ দশক থেকেই বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রীনহাউস গ্যাস তথা মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণের আধিক্যের কথা জানিয়েছেন, যা জলবায়ু পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করেছে। বলা হচ্ছে, গ্রীনহাউস হচ্ছে একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের প্রাণের অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্য এই গ্রীনহাউস প্রক্রিয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তবে মানুষের কর্মকা- এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বর্ধিত জনসংখ্যাকে তুষ্ট করার জন্য মানুষের পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকা- বায়ুম-লে প্রচুর পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণ করেছে। ফলশ্রুতিতে এই পৃথিবী আরও উত্তপ্ত হচ্ছে। একটি উষ্ণতর পৃথিবী মানুষসহ অন্যান্য প্রাণের অস্তিত্বকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিবে। ইতিমধ্যে এই উষ্ণতার কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, কোন কোন দেশে আকস্মিক বন্যা যেমন দেখা দিয়েছে তেমনি কোন কোন দেশে বৃষ্টিহীনতা এবং উষ্ণতার কারণে দীর্ঘমেয়াদী খরা দেখা দিয়েছে। এছাড়া পৃথিবীব্যাপী নানান ধরনের রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এই রোগে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণও আক্রান্ত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, যা তাদের অর্থনৈতিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ুজনিত বিভিন্ন বিপদ ও আপদের কারণে নানান ধরনের ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশে এ বছর দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়েছে। বন্যায় কৃষিকাজ তো ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেই। এই ক্ষতিগ্রস্ততার তালিকায় যুক্ত হয়েছে ঘরবাড়ি, অবকাঠামো এমনকি প্রাণহানীও! আবার বাংলাদেশ উপকূলে ঘন ঘন ঘুর্ণিঝড় হচ্ছে। প্রতিবছর এই ঘূর্ণিঝড়ে অনেক সম্পদ ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসের কারণে কৃষিজমি লোনায় দূষিত হয়ে মানুষের চাষবাসকে বাধাগ্রস্ত করছে।
তিন
আমাদের পৃথিবী আজ সত্যিকার অর্থে চরম বিপদের মধ্যে আছে। দিনকে দিন জলবায়ু পরিবর্তন ক্ষতিকর প্রভাব দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এই পৃথিবীতে অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও পশুপাখি আজ বিলুপ্তির তালিকায় যুক্ত হয়েছে। পৃথিবীর জলবায়ু তাদের বসবাসের উপযোগী না হওয়ায় এসব প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে টিকতে না পেরে অনেক মানুষ তাদের নিজ এলাকা থেকে বিচ্যুত হয়েছে, উদ্বাস্তু হিসেবে অন্য এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বড় বিপদ হচ্ছে উষ্ণতা। দিনকে দিন বিশ্ব আরও উষ্ণ হচ্ছে। মূলত গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ বেড়েছে বলেই এই পৃথিবী আরও উষ্ণ হচ্ছে। একটি প্রতিবেদন মতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা সেই ১৮৮০ সাল থেকেই ০.৮ সেন্টিগ্রেডে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ তাপমাত্রা সবচে’ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে। তবে তাপমাত্রার এই বৃদ্ধি সব এলাকায় সমান নয়। কোন কোন এলাকায় বেশি আবার কোন কোন এলাকায় কম। আর্কটিক অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ বেশি বলে সেখানকার বরফ দিনকে দিনে গলে যাচ্ছে। আর্কটিক বরফ গলে যাওয়ার বিষয়টিই নির্দেশ করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে। উষ্ণতার কারণে সমুদ্রে হিমবাহ গলে যাওয়া এবং পরিমাণও দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যকার সময়ে হিমবাহ গলে যাওয়ার পরিমাণ ৫ গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৬০ সালের তুলনায়! এছাড়া সমুদ্রও উষ্ণ হচ্ছে দিনকে দিন। সমুদ্রের অভ্যন্তরীণকার রসায়নও দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে সমুদ্রে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি থাকার কারণে। বলে রাখা ভালো, মানুষ কর্তৃক নিঃসৃত ৩০% কার্বন ডাই অক্সাইড সমুদ্র শোষণ করতে পারে। এজন্য সমুদ্রকে সবচে’ বড় কার্বন সিঙ্ক (কার্বনশোষণকারী) বিবেচনা করা হয়। এসব কার্বন ডাই অক্সাইড যখন সমুদ্রগুলোর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তখন কার্বনিক এসিড তৈরি হয়। এই এসিডগুলো সমুদ্রে বাসবাস করা অনেক প্রাণী ও বিভিন্ন প্রজাতির তথা প্রবাল প্রাচীর, সেল মাছ, এবং বিভিন্ন ধরনের প্লাঙ্কটন এর জন্য ক্ষতিকর। টিকতে না পেরে তাই এসব সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীও আজ বিলুপ্ত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে পৃথিবী আজ ভারসাম্যতা হারিয়ে ফেলার উপক্রম হচ্ছে। কারণ প্রতিটি সৃষ্টি বা প্রাণ নির্দিষ্ট একটি কর্মপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এই পৃথিবীকে ভালো করে রাখার জন্য। এসব সামুদ্রিক বা ভূ-পৃষ্ঠের প্রাণসমূহ বিলুপ্ত হলে সেই নির্দিষ্ট কর্মপ্রক্রিয়া আর সম্পাদিত হয় না। এছাড়া এসব প্রাণ ও প্রজাতির বিলুপ্তি পৃথিবীর প্রাণ ও প্রকৃতির খাদ্যশৃঙ্খলকেও বাধাগ্রস্ত করে।
চার
জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণসমূহের জন্য কোন ভালো ফল বয়ে আনেনি। জলবায়ু যত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে সমস্যা তত বেশি বেড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণ ও জীবনের পক্ষে এই পরিবর্তন প্রশমন করা প্রায়ই কঠিন। কিন্তু মানুষের জন্য তত কঠিন নয়। কারণ জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন আমরা মানুষেরাই করেছি, পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণসমূহ নয়। পূর্বেই বলা হয়েছে, মানুষের কার্বনভিত্তিক জীবন ও জীবিকাই এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। তাই এই পৃথিবীকে সুন্দরভাবে রাখার জন্য, তার ভারসাম্যতা ঠিক করার জন্য এবং সার্বিকভাবে মানুষসহ পৃথিবীর সব প্রাণসমূহের অস্তিত্ব ও ভালো থাকাকে নিশ্চিত করার জন্য কার্বনভিত্তিক জীবন-জীবিকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কম কার্বন নির্গত হয় এমন জীবন ও জীবিকাকে প্রর্বতন ও গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া মানুষ ইচ্ছে করলে কার্বননিরপেক্ষ জীবন ও জীবিকাও পরিচালনা করতে পারে-এরকম উদাহরণ পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকেই পাওয়া গেছে!