সরকারি ও বেসরকারি কৃষি সেবা ও সুযোগে ছোট কৃষকদের বঞ্চিত করা যাবে না
কৃষি উপকরণের ওপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণহীনতা, ধান রোপণ ও কাটার সময় শ্রমিক সংকট, ধান বিক্রয়ে ন্যায্যমূল্য না পাওয়া প্রভৃতি সমস্যাগুলোর কারণে কৃষিকাজে কৃষক লাভবান হতে পারছেন না। উপরোন্তু নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষকের ফসল নষ্ট হওয়া ঘটনা ঘটেছে অহরহ। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে যেহেতু কৃষকের ফসল কেনার সুযোগ রয়েছে সেহেতু কৃষকরা চান তাদের উৎপাদিত ফসল সরকার যেন ন্যায্য মূল্য দিয়ে কেনে। কৃষকের ফসল কেনার জন্য সরকার ইতিমধ্যে কৃষি কার্ডের ব্যবস্থাও করেছে। কিন্তু এই কৃষি কার্ডে কেবল স্বচ্ছল কৃষকদের প্রবেশাধিকারই বেশি; ক্ষুদ্র কৃষকরা এতে উপেক্ষিত হন বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি কলমাকান্দা উপজেলা কৃষক সংগঠনের উপজেলা পর্যায় সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত একটি সংলাপে কৃষকদের এই সমস্যা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়। এই আলোচনায় অংশ নেন কৃষক, কৃষাণী, কৃষক লীগের সভাপতি, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, স্থানীয় ব্যবসায়ী, কৃষি বিভাগের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবর্গ। বারসিক নিউজ.কম এর পাঠকদের জন্য এই সংলাপের সারাংশ তুলে ধরেছেন কলমাকান্দার অর্পণা ঘাগ্রা, গুঞ্জন রেমা ও খাইরুল ইসলাম অপু:
উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, “কৃষক এককভাবে কোন সমস্যার সমাধান করতে পারেন না।। তাদেরকে সংগঠিত হতে হবে। শ্রমিক ইউনিয়নের সংগঠন রয়েছে। তারা সংগঠিত। এই সংগঠনের জোরেই তারা তাদের কোন সমস্যা বা দাবি জানানোর সাথে সাথেই সারা দেশের মানুষ জেনে যায়।” তিনি বলেন, “উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য কৃষকরা জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে পারেন। নিজ নিজ জায়গায় থেকে এক একজন কৃষক জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের মডেল তৈরি করে দেখাতে পারেন। এতে করে যেমন উৎপাদন খরচ কমবে তেমনি মানুষ সার বিষমুক্ত খাবার খেয়ে সুষ্ঠ সুন্দরভাবে বেচেঁ থাকতে পারবে। সর্বোপরি সেবা গ্রহণের জন্য কৃষকদেরকেই সচেতন হতে হবে। ”
উপজেলা সহকারী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা খন্দকার মাহবুব আলম বলেন, “তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকরা যেন ফসলের ন্যায্যমূল্য পান তার জন্য বর্তমান সরকার কৃষি কার্ডের ব্যবস্থা করেছে। যার মাধ্যমে কৃষকরা ন্যায্য মূল্যে সরকারের কাছে তাদের ফসল বিক্রি করতে পারেন। ক্ষুদ্র্র কৃষকরা যাতে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য যারা ২৫ মণ পর্যন্ত ধান বিক্রি করতে পারেন তাদেরকেও এই কার্ডের সুবিধা দেওয়া হবে।” তিনি জানান, চলতি বছরেই ২৬ হাজার কার্ড দেয়ার সুযোগ হয়েছে। কার্ড বিতরণের পূর্বে মাইকিং করা হয় সর্ব সাধারণকে জানানোর জন্য। সেই সময় কৃষি অফিসে যোগাযোগের মাধ্যমে কৃষক এই কার্ড লাভ করে ন্যায্য মূল্য পেতে পারেন।
কলমাকান্দা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী শেখ গোলাম মৌলা বলেন, “কৃষি ক্ষেত্রে কৃষক যদি ভালো সুযোগ সুবিধা পান তাহলে কৃষি ফসল উৎপাদন বাড়বে। তাই কৃষকদের জন্য সরকারি সেবাসমূহ সম্পর্কে জানাতে ও কৃষিতথ্য দিতে সরকারি কৃষি বিভাগে যারা কর্মরত আছেন তাদেরকে প্রতি গ্রাম ও ওয়ার্ডভিত্তিক সভা করতে হবে। কৃষকদের সচেতন করতে হবে। কৃষি উপকরণের সরবরাহ আরো বাড়াতে হবে। তাহলে তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক উপকৃত হবে ও উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে।”
বেসরকারি সংস্থা ডিএসকে’র মুক্তা পারভীন বলেন, “সরকারি নানান উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোও কৃষকদের পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চার জন্য নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এতে করে শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষাই হচ্ছে না কৃষকদের উৎপাদন খরচও অনেকাংশে কমিয়ে দিচ্ছে। সরকারিভাবে যেসব কৃষি উপকরণ (পাওয়ার টিলার, সেচ মেশিন, ধান কাটার মেশিন) দেওয়া হয় সেগুলো বেশিরভাগই চলে যায় বড় কৃষকদের কাছে। ক্ষুদ্র কৃষকরা সরকারি এইসব সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই এসব উপকরণ দেওয়ার সময় ক্ষুদ্র কৃষকের দিকেও নজর দিতে হবে।”
কৃষক রঞ্জন মোহন দাস বলেন, “হাওরের কৃষকরা শুধুমাত্র বোরো মৌসুমে ধান ফলানোর সুযোগ পায়। তাও আবার পাহাড়ি ঢলের জন্য অনেক সময় ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।” তিনি জানান, কৃষকদের বীজ, সার, বীষ, পানি, শ্রমিক সবকিছু কিনতে হয়। ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক সংকটের কারণে ফসল কাটানোর জন্য কৃষকদের কাঠা প্রতি ৫০০-১০০০ পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়। এক কাঠায় ধান হয় ৩ থেকে ৪ মণ। মণপ্রতি ধানের মূল্য ৫৫০ টাকা। এভাবে হিসেব করলে দেখা যায় ধান চাষে কৃষকদের কোন লাভ নেই! অনেক কৃষক ঋণ নিয়ে ধান আবাদ করেন।কিন্তু ধান কাটার পর যখন ধান থাকে না তখন দেনা পরিশোধ করতেও পারে না। দেনা পরিশোধ করতে না পেরে অনেক কৃষক কৃষি কাজ ছেড়ে ঢাকায় কাজের সন্ধানে চলে যান!